গ্রিন ফলস্–এর গল্প
শিশির বিশ্বাস
জায়গাটা যে ঠিক কোথায়‚ সেদিন জানা হয়নি। দেহাতি মানুষটি হাতের খালি চায়ের গ্লাস নামিয়ে কাঁধের গামছাটা মাথায় দু’পাক জড়িয়ে হঠাৎই হনহন করে চলে গিয়েছিল পাহাড়ি পথ ধরে। জঙ্গলের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিল একটু পরেই।
তবে অভ্র ঘুণাক্ষরেও ব্যাপারটা জানায়নি কাউকে। জানাবার উপায় ছিল না।
হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে হয়তো সন্ধান করা যেত। কিন্তু সেই সময় তখন কোথায়? আশপাশে কত গ্রাম আর চা বাগান। খুঁজে বের করা কি সহজ ব্যাপার! কলকাতায় হস্টেলে থেকে পড়াশুনো করে। বাবার বছর দেড়েক হল পোস্টিং এই শিলিগুড়িতে। তার আগে নর্থ বেঙ্গলে কখনও যাওয়া হয়নি অভ্রর। প্রথম বার পুজোয় বাবা–মায়ের কাছে বেড়াতে এসেই টের পেয়েছিল মজাটা। দারুণ কেটেছিল কয়েকটা দিন। হাতের কাছে পাহাড়‚ জঙ্গল‚ নদী‚ ঝরনা‚ কী নেই। তার উপর শিলিগুড়ির মতো শহর। ছুটির কয়েকটা দিন যে কোথা দিয়ে পার হয়ে গিয়েছিল‚ টেরই পায়নি। সেই থেকে ছোটখাটো ছুটিতেও চলে আসে এখানে। তবে বাবা–মা দু’জনেই বিলক্ষণ চেনেন তাদের এই ছেলেটিকে। অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেলেই আর জ্ঞান থাকে না। আর এই ডুয়ার্সে অভাব নেই ওই বস্তুর। সুতরাং যে কয়দিন থাকা হয়‚ সব সময় চোখে চোখে। তবু ওর মধ্যেই গত বছর একদিন ফাঁক পেয়ে চলে গিয়েছিল কালিঝোরার দিকে। গ্রিন ফলসের কথা সেবার ওই কালিঝোরার জঙ্গলে শুনেছিল। পাহাড়ি সেই দেহাতি মানুষটার কাছে।
বাবা–মা যাই ভাবুক‚ অভ্র হঠকারী নয়। বাস থেকে নেমে আপন মনে ঘুরতে ঘুরতে আলাপ হয়েছিল মানুষটার সঙ্গে। গ্রামের সহজ সরল পাহাড়ি মানুষ। অলস বেলায় বসেছিল পথের পাশে ছোট এক দোকানের সামনে। হতে তেমন কাজ ছিল না হয়তো। অভ্রর অনুরোধে সারা বেলা ঘুরেছিল ওকে নিয়ে। বনবাংলো পার হয়ে তিস্তা নদীর পারে বালির উপর বিছিয়ে থাকা নুড়ি পাথর আর ঘন ঘাসবন ধরে চলে গিয়েছিল অনেক দূর পর্যন্ত। মাথার উপর মস্ত নীল আকাশে হালকা মেঘের আনাগোনা। যতদূর চোখ যায় শুধু ঢেউ খেলানো পাহাড়‚ জঙ্গল। তিস্তার কুলকুল। শিলিগুড়ি থেকে সঙ্গে কিছু খাবার কিনে এনেছিল। ভাগাভাগি করে খেয়েছিল। সব মিলিয়ে দারুণ কেটেছিল সময়টা। গ্রিন ফলসের কথা ওই লোকটাই বলেছিল সেদিন। পাহাড়ে উপর অনেক উঁচুতে ঘন জঙ্গলের ভিতর চমৎকার একটা ঝরনা আছে। সারা বছর জল পড়ে অবিরাম ধারায়। নীচে ছোট এক কুণ্ড। টলটলে জল উপচে গড়িয়ে যায় পাথরের ফাঁক দিয়ে। চারপাশে শুধু বুনো কলার ঝাড়। ওই টানে হাতির পাল প্রায়ই চলে আসে। পেট ভরে খেয়ে গা ডুবিয়ে স্নান সারে কুণ্ডের জলে।
শুনেই অভ্রর ভিতরটা চনমন করে উঠেছিল। কিন্তু তারপরেই ছন্দপতন। কথার মাঝেই হঠাৎ কেমন থমকে গিয়েছিল মানুষটা। বনবাংলোর পিছনে নড়বড়ে এক ঝোলা ব্রিজ। কাছে চায়ের ঠেকের ধারে গাছের গুঁড়ির উপর বসে চায়ের গ্লাস হাতে তখন গল্প চলছিল। লোকটার সহজ সরল চোখদুটো কেমন দুলে উঠেছিল হঠাৎ। তারপর এক চুমুকে গ্লাসের বাকি চা শেষ করে ঠকাস শব্দে সেটা নামিয়ে রেখেই দ্রুত সাঁকো পার হয়ে ওপারের জঙ্গলের আড়ালে মিলিয়ে গিয়েছিল। অভ্র কথা বলার সুযোগই পায়নি।
বেলা তখন অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। তাই ইচ্ছে থাকলেও লোকটার খোঁজে আর যাওয়া হয়নি। ভিতরে ইচ্ছেটা অবশ্য রয়েই গেছে। হয়তো পূরণ করেও ফেলত। কিন্তু তার মধ্যেই এক ব্যাপার। মুখ ফসকে একদিন ক্লাসের বন্ধু সন্তুকে বলে ফেলেছিল ব্যাপারটা। সন্তু তক্ষুনি জানিয়ে দিয়েছিল‚ গ্রিন ফলস দেখতে সেও সঙ্গে যাবে। সন্তুর কথা ফেলতে পারেনি অভ্র। একে তো ক্লাসে সব চাইতে কাছের বন্ধু। তার উপর অভ্রর মতোই ডাকাবুকো। এমন একজন সঙ্গে থাকলে সুবিধাই হয়। রাজি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরের কয়েক দফায় নানা করণে সন্তুর শিলিগুড়িতে আসা হয়নি। ইচ্ছে হলেও বন্ধুর কথা ভেবে তাই উপায় ছিল না। তবে একটা ব্যাপার হয়েছে। এর মধ্যে বার দুয়েক শিলিগুড়ি আসার সুযোগ হয়েছে অভ্রর। গ্রিন ফলসের ব্যাপারে আরও কিছু খোঁজখবর পেয়েছে মংলুর কাছে।
মংলু ছেলেটার বয়স বেশি নয়। পাহাড়ের দিকে এক অজ গ্রামে থাকে। পড়াশুনোর পাট নেই। আসলে ওদের গ্রামে কেউ লেখাপড়া শেখে না। ইশকুল–পাঠশালাও নেই। একটু বড় হতেই পেটের ধান্দায় পাহাড়–জঙ্গল ঘুরে বেড়ায়। ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল শিলিগুড়ির কাছে এক চা বাগানে। বাপ–কাকার সঙ্গে কাজের খোঁজে এসেছে। এই মংলুর কাছেও ও গ্রিন ফলসের কথা পেড়েছিল। মংলু চিনতে পারেনি। তবে বলেছিল‚ কালিঝোরার ওদিকে এক ঝরনার কথা। বলেছিল পাহাড়ের অনেক উঁচুতে গভীর জঙ্গলের ভিতর এক মহাকাল মন্দিরের কথাও। পূর্ণিমার রাতে বুনো হাতির পাল নাকি পুজো দিতে আসে সেই মন্দিরে। রাতভর মন্দির ঘিরে নেচে বেড়ায়। তার আগে চান করতে আসে সেই ঝোরায়।
শোনা কথা নয়। হাতির সেই নাচ মংলু একবার নিজের চোখেই দেখেছে। একবার ও ঘুরতে ঘুরতে চলে গিয়েছিল সেই মহাকাল মন্দিরে। সেদিন যে পূর্ণিমা‚ জানত না। অনেকটা উঁচুতে মন্দির। একে তো পরিশ্রম কম হয়নি। তার উপর সারাদিন পেটেও কিছু পড়েনি। ক্লান্তিতে মন্দিরের চাতালে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওর সেই ঘুম যখন ভাঙল‚ অনেক রাত। চোখ মেলে দেখে সারা মন্দির জ্যোৎস্নার আলোয় ম–ম করছে। কয়েক পাল হাতি উপুড় হয়ে নিঃশব্দে বসে আছে সামনে চত্বরের উপর। সেই দৃশ্য দেখে ভয়ে হিম হয়ে গিয়েছিল ও। কিন্তু হাতির পাল কোনও ক্ষতি করেনি। ও উঠে বসতেই সর্দার হাতি শুঁড় তুলে জোরাল আওয়াজে ডেকে উঠেছিল বার কয়েক। সেই আওয়াজে অন্য হাতিরা এরপর উঠে দাঁড়িয়ে মন্দির ঘিরে নাচ জুড়েছিল। সারা রাত ধরে দলে দলে আরও হা যোগ দিয়েছিল তাদের সঙ্গে। শুঁড়ে পেঁচিয়ে বুনো কলার কাঁদিও নিয়ে এসেছিল কেউ। তারপর ভোর হতে সর্দার হাতি ওকে পিঠে তুলে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল গ্রামের কাছে। রাতে এক কাঁদি কলাও খেতে দিয়েছিল। আরও অনেক অদ্ভুত কথা বলেছিল ছেলেটা।
তার সব অবশ্য অভ্রর বিশ্বাস হয়নি। তবে তাতে গ্রিন ফলসে যাওয়ার ইচ্ছেয় ভাঁটা পড়েনি। বরং বেড়েছিল আরও।
এবার পুজোর ছুটিতে তাই আটঘাট বেঁধেই দুই বন্ধুর শিলিগুড়ি আসা। সন্তুর দোহাই পেড়ে বাবা–মাকে রাজি করাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। অবশ্য আসল ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেনি। দু’জন বের হয়ে পড়েছে পরের দিন ভোরেই।
শিলিগুড়ি থেকে ট্রেকার ধরে কালিঝোরা। ছোট্ট ছিমছাম পাহাড়ি গ্রাম পার হয়ে পথের পাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে তিস্তার ধারে দুর্দান্ত এক ফরেস্ট বাংলো। অভ্র আগেও এখানে বার দুই এসেছে। সবাই মিলে কাটিয়ে গেছে রাত। বাংলোর বারান্দায় বসে নীচের তিস্তা ‚ ওপারে অরণ্যময় পাহাড়‚ নদীর পাড়ে বিস্তীর্ণ ঘাসের জঙ্গল দেখে দিন কেটে গেছে। তারপর তো একাই ঘুরে গেছে সেবার। কালিঝোরা তাই ভালই চেনা। বাবা–মা যে রাজি হয়েছেন‚ তা ওই কারণেই। কিন্তু এত কাঠখড় পুড়িয়ে আজ দু’জন কালিঝোরা দেখতে আসেনি। তাই সময় নষ্ট না করে ফরেস্ট বাংলোর কাছে ব্রিজ পার হয়ে এসে পড়ল ওদিকের পাহাড়ে। ঘন জঙ্গলের ভিতর সরু এক পায়ে চলা পাহাড়ি পথ। আগের বার সেই দেহাতি মানুষটি এই পথেই নিয়ে এসেছিল। তবে বেশি ভিতরে যায়নি। লোকটা না ভাঙলেও এই পথটাই যে গ্রিন ফলসের দিকে গেছে‚ বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
দু’জনের মনের ভিতর প্রস্তুতি তাই একটা ছিলই। তৈরি হয়ে এসেছিল সেই ভাবেই। পরনে জংলা রঙের হাফ প্যান্ট আর শার্ট। পায়ে হান্টার সু। কাঁধে ছোট এক রুকস্যাক। পাহাড়ি পথে চলতে অসুবিধা হবার কথা নয়। কিন্তু পথ যে এতটা দুর্গম‚ ভাবতেই পারেনি। ঘন–ঘন খাড়াই পাকদণ্ডী। সীমাহীন চড়াই আর চড়াই। খানিক উঠতেই হাঁপ ধরে যায়। অথচ থামার উপায় নেই। হাতে সময় কম। তার উপর পথের রেখাও অনেক স্থানে প্রায় বিলীন। অনুমানে বুঝে নিতে হয়। জনবসতি কাছে হলেও মানুষ এদিকে যে কালেভদ্রে আসে‚ বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবু সাহস হারায়নি কেউ। বরং খানিক চড়াই ভাঙার পর ব্যাপারটা গা–সওয়া হয়ে গেলে ভিতরে একটা অন্য অনুভূতিও টের পাচ্ছিল। মহানন্দা অভয়ারণ্যে আগেও তো এসেছে। কিন্তু এই রূপের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। চারপাশে শুধু শাল‚ সেগুন‚ গুদাল আর ময়নার অরণ্য। আকাশ ছোঁওয়া ধুপি। নাম না জানা অসংখ্য লতাপাতা। সেই সাথে বুনো কলার ঝাড়। বাতাসে ভিজে মাটি‚ পাথর‚ শ্যাওলা আর গাছ–পাতার এক অদ্ভুত আদিম গন্ধ। পাখির ডাক। সব মিলিয়ে অন্য এক জগত। চলতে কষ্ট হলেও ভুলে যেতে সময় লাগে না। অন্য এক অনুভূতিতে মন ভরে যায়।
ওরা খুব আসা করেছিল‚ পথে এক–আধজন মানুষের দেখা পেয়ে যাবে। পথ ঠিক আছে কিনা জেনে নিতে পারবে। কিন্তু তেমন কাউকেই পাওয়া যায়নি। তাই সন্দেহ একটা রয়েই গেছে। তার উপর একটানা কঠিন চড়াই ভাঙার পর শুরু হল উতরাই। চলার গতি তাই বাড়ল। ভিতরে চাপা ভয় মেশানো উত্তেজনা। তবু উৎসাহে পাহাড়ি ঢালু পথ বেয়ে দ্রুত নেমে চলল। একসময় তো সন্দেহ হচ্ছিল‚ এই উতরাইয়ের কি শেষ নেই। কোথায় চলেছে ওরা। পথ যদি ভুল হয়‚ ফের চড়াই ভাঙতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশঙ্কা সত্যি হয়নি। সামনে দেখা মিলল ছোট এক পাহাড়ি নদীর। কলকল শব্দে জলস্রোত বইছে। দুই ধারে পাহাড়ে আছড়ে পড়ছে ফেনিল জলরাশি। নদীর সেই গর্জন ছাপিয়ে আর এক গর্জনও কানে বাজছিল। আরও গুরুগম্ভীর। টের পেতেই উৎসাহে দু’জন হাততালি দিয়ে উঠল। সন্দেহ নেই‚ শেষ পর্যন্ত গ্রিন ফলসের কাছে এসে পড়েছে ওরা। খানিক এগিয়ে পাহাড়ের একটা বাঁক। পার হতেই নজরে পড়ল সামনে পাহাড় টপকে বড় এক ঝরনা আছড়ে পড়ছে নীচের এক কুণ্ডে।
অক্টোবর মাস। সমতলে বৃষ্টি ইতিমধ্যে বিদায় নিলেও পাহাড়ে যে অন্য রকম‚ সামনে জলপ্রপাতের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ছোট কুণ্ড জলে প্রায় টইটুম্বুর। টলটলে জল উপচে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী বেয়ে। ইতিউতি ছড়িয়ে অসংখ্য বোল্ডার। সেদিকে তাকালে বোঝা যায়‚ কদিন আগে কুণ্ডে জল ছিল আরও বেশি। কুণ্ডও তখন আরও বড় ছিল। নদীও ছিল আরও তেজি।
চারপাশে পাহাড় ঘেরা সেই ঘন অরণ্যর মাঝে ছবির মতো সেই কুণ্ড‚ চারপাশে বুনো কলার ঝাড় আর দীর্ঘ জলপ্রপাতের দিকে ওরা হাঁ করে তাকিয়ে রইল খানিক। কারও মুখে কথা নেই। কিন্তু সে সামান্য সময় মাত্র। তারপরেই খুশিতে চিৎকার করে উঠল। অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধেই তো এদিকে পাড়ি জমানো। কিন্তু এতটা উপরি মিলবে‚ আশা করেনি কেউ। মুহূর্তে পিঠের রুকস্যাক নামিয়ে সর্টস পরে লাফিয়ে পড়ল কুণ্ডের জলে। জুড়িয়ে গেল শরীর।
তারপর খুশিতে কুণ্ডের সেই টলটলে জলে দাপিয়ে স্নান। গোড়ায় একটু ভয়–ভয় করছিল। নির্জন অরণ্যে শুধু জল পড়ার গমগম শব্দ। কশ্চিৎ দু’একটা পাখির ডাক। এছাড়া কোনও সাড়াশব্দ নেই। কিন্তু সেটা কাটতে সময় লাগল না। টলটলে জলে ঢেউয়ের মালা আছড়ে পড়ছে দু’জনের গায়ে। ফেনার রাশি। পাথরের ফাঁকে ছোট মাছের ঝাঁক। দেখতে দেখতে খুশিতে মেতে উঠল দু’জন। অভ্র তো ঠিক করে ফেলল‚ বাড়িতে ফিরেই খুলে বলবে সব। এমন দুর্দান্ত জায়গাটা দেখা হবে না বাবা–মার। কতটুকুই বা পথ। পুজোর ছুটি শেষ হবার আগেই সবাই চলে আসবে একদিন।
দারুণ খুশিতে ওইভাবে কতক্ষণ দু’জন কুণ্ডের জলে স্নান করেছিল‚ খেয়াল নেই। ওদিকে সূর্য যে ঢলে পড়তে শুরু করেছে‚ অরণ্য পথে ফের চড়াই ভেঙে ফিরতে হবে‚ মনেই হয়নি। হঠাৎ খেয়াল হল‚ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তেমন জোরে নয়। গোড়ায় তাই মজাই লাগছিল। তারপরেই বৃষ্টি শুধু কুণ্ডের জলেই। খানিক দূরে পাড়ের মাটি–পাথর‚ ঝরা পাতা শুকনো খটখটে। পাহাড়ে এমন বৃষ্টিও হয় নাকি! ঘাড় ফিরিয়ে চারপাশে তাকাল ওরা। আর তারপরে যা দেখল‚ তাতে বুকের রক্ত মুহূর্তে হিম।
কী ভয়ানক! অদূরে কুণ্ডের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছোট এক হাতির পাল। সব মিলিয়ে গোটা দশেক। দলে ছোট–বড় বাচ্চাও রয়েছে। সবাই মিলে কুণ্ড থেকে শুঁড়ে জল তুলে ছিটিয়ে দিচ্ছে। কখন এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে‚ কেউ বুঝতেই পারেনি। সন্তু এদিকে নতুন। আতঙ্কে অভ্রর হাত চেপে ধরল। এমন অভিজ্ঞতা আগে অভ্ররও হয়নি। কী ভয়ানক! মাত্র হাত দশেক দূরে বুনো হাতির পাল!
অভ্র বরাবরই কিছু ডাকাবুকো গোছের। ভয়ডর কম। তবু ওই দৃশ্য গোড়ায় ওর সারা শরীর প্রায় হিম করে দিয়েছিল। কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্য। মাথাটা সামান্য থিতু হতে ওর মনে হল‚ প্রাণীগুলো নিঃশব্দে ওদের এত কাছে হাজির হলেও সম্ভবত খারাপ উদ্দেশ্য নেই। তেমন হলে এভাবে জল ছেটাত না। দলের সর্দার দাঁতাল হাতিটার চোখের দৃষ্টি খরখরে হলেও রয়েছে সবার পিছনে। কুলোর আকারের দুই কান সন্দেহের দোলায় ঘন ঘন নড়তে থাকলেও বাকি হাতিগুলোর চোখে হালকা কৌতুকের আভাষ। হঠাৎ সেই দেহাতি মানুষটির কথা মনে পড়ে গেল অভ্রর। লোকটা সেদিন বলেছিল‚ ঝরনার এই কুণ্ডের জলে স্নান করতে আসে বুনো হাতির পাল। একই কথা বলেছিল মংলু ছেলেটাও। আরও অনেক কথা শুনেছিল ওর কাছে। তবে কী আজ পূর্ণিমা? ও পাশে সন্তুর দিকে তাকাল। বেচারা তখনও সামলে উঠতে পারেনি। সারা মুখ ফ্যাকাসে। ও এক মুহূর্ত দেরি না করে সন্তুর হাত ধরে ধীরে ধীরে জল ভেঙে টেনে নিয়ে গেল কুণ্ডের পাড়ের দিকে। সামনে একটা পাথরের উপর ওদের রুকস্যাক দুটো। কোনওমতে তুলে নিয়ে সন্তর্পণে পিছনে তাকাল। জল ছেটানো বন্ধ করে হাতিগুলো তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। সর্দার দাঁতাল হাতিটা শুঁড় উঁচিয়ে কটমট চোখে সমানে কান দুলিয়ে চলেছে। সে অর্থ বুঝে নিতে দেরি হয়নি।
প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে পাহাড় ভেঙে অনেকটা উঠে আসার পর একটু স্বস্তি বোধ করতে জিরিয়ে নেবার জন্য একসময় থামল ওরা। কৌতূহলে ঘাড় ফেরাতে অবাক হয়ে দেখল‚ গোটা কুড়ি হাতির আর একটা দল ইতিমধ্যে হাজির হয়েছে সেখানে। অভ্র হাঁ করে দেখছিল। সন্তু হঠাৎ ওর হাত চেপে ধরল। চাপা গলায় বলল‚ ‘অভ্র‚ ওরা কিন্তু নজর রাখছে আমাদের দিকে। ওই…।’
সন্তুর কথা শেষ হতে পেল না। পোঁ–ও–ও–ও শব্দে তীব্র আওয়াজ উঠল ওদিক থেকে। প্রায় কেঁপে উঠে অভ্র দেখল গোটা কয়েক দাঁতাল কুণ্ড ছেড়ে খানিক এগিয়ে এসে লক্ষ রাখছে ওদের উপর। সন্দেহ নেই‚ ওদের দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে শুঁড় উঁচিয়ে শাসাতে শুরু করেছে। অগত্যা ফের দৌড়।
প্রায় মাইল খানেকের আগে আর থামতে ভরসা হয়নি। জামাপ্যান্ট পালটে সামান্য জিরিয়ে নেবার পর প্রথম কথা বলল অভ্র‚ ‘সন্তু‚ আজ কি পূর্ণিমা?’
শহরের মানুষ পূর্ণিমা–অমাবস্যার খবর বড়ো একটা রাখে না। জানা ছিল না সন্তুরও। ও ঘাড় নেড়ে বলল‚ ‘জানি না রে। কেন বল তো?’
‘বড্ড বেঁচে গেছিরে আজ!’ সন্তুর প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে অভ্র বলল‚ ‘ভয়ানক বিপদ হতে পারত। আগেই বোঝা উচিত ছিল।’
ডাকাবুকো অভ্রর কাছে থেকে সন্তু এমন কথা আশা করেনি। অকুস্থল থেকে অনেকটা দূরে এসে ও তখন বেশ ধাতস্থ। অল্প হেসে বলল‚ ‘কিন্তু কী বিন্দাস একটা অ্যাডভেঞ্চার হল বল? সারা জীবন মনে থাকবে। সঙ্গে ক্যামেরা ছিল। যদি ছবি তুলে নিতে পারতাম!’
‘ভাগ্যিস সে চেষ্টা করিসনি।’ তাড়াতাড়ি অভ্র বলল‚ ‘চল ওঠা যাক এবার। দেরি করা ঠিক হবে না।’
অভ্রর আশঙ্কা যে এখনও কাটেনি‚ বুঝতে পারছিল সন্তু। ওর আর একটু জিরিয়ে নেবার ইচ্ছে ছিল। তবু উঠে দাঁড়াল।
অভ্রর আশঙ্কা যে অমূলক নয়‚ বুঝতে বিলম্ব হল না সন্তুর। অভ্র তারপর আর একটি কথাও বলেনি। সন্তুও তাই নিঃশব্দে পথ চলছিল। মিনিট কুড়ি চলার পর হঠাৎ খসখস শব্দে হাত কয়েক দূরে ঘন গাছপালার দিকে চোখ পড়তে সন্তু ভয়ার্ত গলায় বলল‚ ‘অভ্র‚ সাবধান।’
সন্তুর কথা শেষ হতে না হতেই গাছপালার আড়াল থেকে বিশাল এক দাঁতাল হাতির শুঁড় বের হয়ে ওদের সামনে দুলতে লাগল। দারুণ আতঙ্কে সন্তু প্রায় কাঠ হয়ে গেছে তখন। ঘাড় ফিরিয়ে কাঠ হয়ে গেছে অভ্রও। কিন্তু গাছপালার ভিতর চোখ পড়তে তার বুক থেকে বড় একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে এলো। ধরা গলা কোনোক্রমে ঝেড়ে নিয়ে বলল‚ ‘কে? মংলু না!’
ততক্ষণে গাছপাতার আড়াল থেকে হাতিটা অনেকটাই বের হয়ে এসেছে। পিঠের উপর বসে রোগা এক দেহাতি ছেলে। খালি গা। পরনে ময়লা ট্যানা। হাতিটা বের হয়ে আসতেই ছেলেটা সড়াৎ করে শুঁড় বেয়ে নেমে এলো নীচে। ও নেমে পড়তেই হাতিটা পিছু হেঁটে ফের ঢুকে পড়ল গাছপালার আড়ালে। ছেলেটি এবার তাকাল ওদের দিকে। উদ্বিগ্ন গলায় বলল‚ ‘বাবু‚ তুমি এদিকে! এই দিনে! বিপদ হয়নি তো? এদিকে আসার ইচ্ছে‚ সেদিন বললেই পারতে।’
‘ভুল হয়ে গেছে মংলু।’ মাথা নেড়ে অভ্র বলল‚ ‘একটু এগিয়ে দিয়ে আসতে পারবে? এখনও অনেকটা পথ বাকি।’
মংলু এক মুহূর্ত কী ভাবল। তারপর কোমরের কষি থেকে একটা ইঞ্চি তিনেক লম্বা সরু বাঁশের বাঁশি বের করে গাল ফুলিয়ে ঘন–ঘন ফুঁ দিতে লাগল। বাঁশির কিছুমাত্র আওয়াজ ওরা শুনতে পারছিল না। শেষ বার ফুঁ দিয়ে মংলু বাঁশিটা ফের কোমরে গুঁজে বলল‚ ‘আজ যে একেবারে সময় নেই বাবু। সেই মহাকাল মন্দিরে যেতে হবে। সন্ধের আগেই। তবে আর বিপদ হবে না। নিশ্চিন্তে যেতে পারবে।’
‘ধন্যবাদ ভাই। ফের যদি দেখা হয়‚ তখন কথা হবে আবার। চলি।’
বিদায় জানিয়ে সন্তুকে নিয়ে চলতে শুরু করল অভ্র। হঠাৎ ওই ঘটনায় প্রায় থ হয়ে গিয়েছিল সন্তু। অনেকটা হেঁটে আসার পর বল‚ ‘মাহুত ছেলেটাকে চিনতিস তুই!’
উত্তরে অভ্র সামান্য মাথা নড়ল। কথা বলল না। আসলে মংলু যে মাহুত নয়‚ ওর বাহনটাও যে বন্য হাতি‚ সে কথা ভাঙতে গেলে অনেক কিছুই বলতে হয় এখন। তারপর সেসব কথা বিশ্বাস করাও শক্ত।
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
প্রথম প্রকাশ: ২০১৩ শারদীয়া ‘কিশোর ভারতী’
আপলোড: ২৭/৮/২০১৭
No comments:
Post a Comment