Monday 2 January 2017

গল্প (মোবাইল ভার্শন) : আইসক্রিমওয়ালা (শিশির বিশ্বাস)

আইসক্রিমওয়ালা

শিশির বিশ্বাস
    ছরের একটা সময় সূর্যটা গনগনে হয়ে ওঠে। সেই দারুণ আঁচে ওদের এই দুর্গাপুর শহর তখন ফুটিফাটা হয়ে যায়। দুপুরের আগেই পথে কমে আসে মানুষ। ধুঁকতে থাকে শহরটা। কেন এমন হয় সূর্য কেনও এমন ভয়ানক হয়ে ওঠে বুঝে উঠতে পারে না ছেলেটা। আসলে কোনও কিছুই তেমন সহজে বুঝে উঠতে পারে না বেচারা। সহজে কিছু করেও উঠতে পারে না। ঢিলেঢালা গোছের ছেলেটা হামেশাই খোঁচায় বেধে ছিঁড়ে ফেলে জামা–প্যান্ট। বই–খাতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে কখনও। ক্লাসে সারাটা সময় কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকে লাস্ট বেঞ্চে। দ্রুতপাঠের পিরিয়ডে যখন ওর পালা আসে ঘেমে–নেয়ে বই হাতে কোনওমতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর তোতলাতে শুরু করে। হেসে ওঠে সারা ক্লাস। দু’এক লাইনের বেশি পড়ে উঠতে পারে না। মাস্টারমশাই ওকে থামিয়ে চলে যান পরের জনের কাছে।
দিন কয়েক আগে ক্লাসে ওই শীত–গ্রীষ্মের ব্যাপারটাই বোঝাচ্ছিলেন মাস্টারমশাই। পৃথিবীর বার্ষিক গতি। বেচারা বুঝতে পারেনি তেমন। গোড়ার দিকে বেশ আগ্রহ নিয়ে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যত এগোতে লাগল ক্রমশ গুলিয়ে আসতে লাগল। প্রশ্ন করে হয়তা জেনে নেওয়া যেত। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেনি। বরং ওর মাথায় তখন পাক খাচ্ছিল অন্য এক ব্যাপার। সেই অদ্ভুত মানুষটার কথা। একমাথা রুক্ষ চুল। তেল পড়েনি অনেক দিন। পরনে তালি দেওয়া বিবর্ণ একটা হাফ প্যান্টের সঙ্গে আধছেঁড়া শার্ট। দুপুরে দারুণ রোদ আর গরমে যখন হাঁপাতে থাকে ওদের গলিটা শীর্ণ মানুষটাকে তখন দেখা যায় পথে। পিঠে বড় একটা বাক্স ঝুলিয়ে ঈষ কুঁজো হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে আসে। গনগনে রাস্তায় খালি পায়ে চলতে চলতে সুরেলা গলায় হাঁক পাড়ে ‘আইক্রিম আইসক্রিম চাই।’
পিঠের ওই বাক্সে এক চমৎকার জগ বয়ে আনে মানুষটা। এই দারুণ গরমে স্বপ্নের মতো এক টুকরো শীতল মনোরম পরিবেশ। এক একটা আইসক্রিমের দাম পঁচিশ পয়সা। তাও থাকে না ওদের এই গলির অনেকের কাছেই। তবু ওই ডাক শুনলেই হইহই করে বের হয়ে আসে ছোটরা। খদ্দের জুটলে লোকটা ধীরেসুস্থে নামায় বাক্সটা। কাঁধের তেলচিটে গামছায় মুখের জবজবে ঘাম মুছে ঢাকনা খোলে। দ্রুত একটা আইসক্রিম বের করে মুহূর্তে বন্ধ করে দেয় আবার। এই সময়টার জন্যই হাঁ করে থাকে ছেলেটা। ঘেঁসে আসে বাক্সটার কাছে। মুহূর্তের জন্য হলেও ওই সময় এক টুকরো হিমেল পরশের ছোঁওয়া পাওয়া যায়। পয়সা জোটেনা রোজ। আর জুটলেও আরামে আইসক্রিম চাটতে চাটতে ঘেঁসে থাকে লোকটার অদ্ভুত ওই বাক্সটার কাছে। ফের ঢাকনা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাথার ভিতর কত কিছু ঘুরে বেড়ায় তখন। মনে হয় লোকটার ওই বাক্স যদি আরও অনেক অনেক বড় হত ওদের এই দুর্গাপুর শহরটাকে যদি ভরে ফেলা যেত তার ভিতর কী ভালই না হত তা হলে! হাঁফ ছেড়ে বাঁচত সবাই। সাহস করে একদিন সেকথা বলেও ফেলেছিল লোকটাকে।
শুনে মানুষটা ম্লান হেসে বলেছিল ‘সে যে অনেক মেহনতের ব্যাপার খোকাবাবু! অত শক্তি যে আমার নেই ভাই।’
একটু লজ্জাই পেয়েছিল ছেলেটা। সত্যিই তো! ওই ছোট বাক্স বইতেই শীর্ণ মানুষটা নুয়ে পড়ে। পায়ে একজোড়া জুতোও নেই। দুপুরের রোদে তেতে ওঠা এই ভয়ানক রাস্তায় ওইভাবে কি হাঁটা যায়? অনেক ভেবে ঠিক করেছিল নিজের চটিজোড়া দিয়ে দেবে ওকে। সকালে স্কুল। কয়েকটা মাস খালি পায়ে ঠিক চালিয়ে নিতে পারবে। মা জিজ্ঞাসাও করবেন না। ভাববেন বই–খাতার মতো এবার জুতোও হারিয়ে ফেলেছে তার হাবাগোবা ছেলেটা। তবু মুশকিল ওই মা’কে নিয়েই। ছোট এক কারখানায় ঠিকে কাজ করেন। মা–ছেলের কোনওমতে চলে যায়। দুপুরের টিফিন বাঁচিয়ে মা ঠিক কিনে আনবেন নতুন একজোড়া জুতো। ও কিছুতেই বোঝাতে পারবে না কয়েকটা মাস খালি পায়ে ঠিক চালিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু আরও অনেক কিছুর মতো ছেলেটা এই কাজটাও শেষ পর্যন্ত হয়নি। ও অবশ্য একদিন লোকটাকে বলেছিল ‘আইসক্রিমকাকু আমার চটিটা নেবে তুমি?’
শুনে অবাক চোখে তাকিয়েছিল মানুষটা। তারপর ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছিল ‘খোকাবাবু তোমার ওই ছোট পায়ের চটিতে যে আমার হবে না ভাই।’
তাইতো! ব্যাপারটা একবারও ভাবেনি ছেলেটা। ও কুঁকড়ে গিয়েছিল লজ্জায়। লোকটা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল ‘তাতে কী হয়েছে খোকাবাবু।’
‘কিন্তু এই গরমে কষ্ট হয় না তোমার?’ বলেছিল ছেলেটা।
‘তা হয় হয়তো।’ লোকটা ওর আরও কাছে ঘেঁসে এসেছিল ‘আসলে ব্যাপারটা কী জানো? কাউকে তো কষ্ট করতেই হবে। নইলে কবেই থেমে যেত সবকিছু। তুমি কিন্তু বড় হবে খোকাবাবু। অনেক বড়।’
লোকটার গোড়ার দিকের কথা সব বুঝতে পারেনি ছেলেটা। কিন্তু ওই শেষের কথায় হেসে ফেলেছিল শেষ পর্যন্ত। কারণ ওর যে কিছু হবে না, তা সবাই জানে। ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে। পড়া পারে না। হারিয়ে ফেলে বই–খাতা। সবই বলে ভোম্বল। এমনকী মাস্টারমশাইরা র্প্যন্ত। শুনে শুনে ওর নিজেরই কখনও মনে হয়‚ বুঝি ওটাই ওর আসল নাম।
দুর্গাপুর মিউনিসিপ্যালিটি স্কুলের ক্লাস থ্রি’র লাস্ট বয় সেই ছেলেটা এভাবেই হয়তো হারিয়ে যেত একদিন। যেভাবে হারিয়ে যায় ভোম্বলদের মতো আরও অনেকে। কিন্তু হঠা সামান্য ব্যতিক্রম হয়ে গেল। স্কুলে সেবার একজন নতুন মাস্টার এলেন। বয়স তেমন বেশি নয়। গালে হালকা দাড়ি–গোঁফ। সরু সোনালি ফ্রেমের চশমার আড়ালে স্বপ্নময় দুটি চোখ। প্রথম দিন প্রথম দিন ক্লাসে এসেই মানুষটি কাঁধের ঝোলা থেকে বের করলেন ছবিতে ভরা গোটা কয়েক বই। চমৎকার কণ্ঠস্বরে একে একে পড়ে গেলেন কয়েকটা গল্প। এই প্রথম ছেলেটা ক্লাসে হাঁ করে শুনল মাস্টারমশায়ের কথা। নীল সমুদ্রের অভিযাত্রী কলম্বাসের গল্পটা যখন উনি পড়ছিলেন, সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল। অথচ কলম্বাসের কথা পড়ার বইতেও রয়েছে। ক্লাসে পড়ানও হয়ে গেছে। একটুও ভাল লাগেনি তখন।
প্রথম পিরিয়ডটা বড্ড তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল সেদিন। ঘণ্টা পড়তেই বই বন্ধ করলেন নতুন মাস্টারমশাই। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘হেডমাস্টারমশাইকে বলে আজ পরের পিরিয়ডটাও চেয়ে নিয়েছি। তবে এই পিরিয়ডে গল্প নয়, ক্লাসের কাজ দেব একটা। তোমরা বড় হয়ে কে কী হতে চাও, অল্প কথায় চটপট লিখে ফেল দেখি।’
শুনে মুষড়ে পড়েছিল ছেলেটা। একটু আগের সব উৎসাহ নিবে গিয়েছিল মুহূর্তে। কিন্তু নতুন মাস্টারমশাই যখন জানালেন, লিখতে হবে সবাইকেই। পিরিয়ডের শেষে প্রত্যেকের কাছে গিয়ে খাতা নেবেন। অগত্যা খাতা পেনসিল নিয়ে বসতেই হল তাকে। গোটা গোটা অক্ষরে লিখেও ফেলল কয়েকটা লাইন। পিরিয়ড শেষ হতে খাতাগুলো ঝোলায় ভরে চলে গেলেন তিনি।
পরের দিন যথা সময়ে নতুন মাস্টারমশাই হাজির হয়েছেন ক্লাসে। ছেলেটা ভুলেই গিয়েছিল আগের দিনের কথা। কিন্তু চেয়ারে বসেই তিনি যখন ঝুলি থেকে খাতাগুলো বের করলেন, বেচারা কুঁকড়ে আধখানা হয়ে গেল। ততক্ষণে খাতাগুলো তিনি টেবিলের উপর রেখেছেন। সামনে ছেলেদের উপর সামান্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘গতকাল আসল কাজটাই করা হয়নি। তোমাদের সাথে পরিচয়পর্ব। এক ফাঁকে সেটা সেরে নেব আজ। তবে তার আগে বলি, তোমাদের খাতাগুলো আমি দেখেছি। অনেকের লেখাই খুব ভাল হয়েছে। কেউ ডাক্তার হতে চাও, কেউ ইঞ্জিনিযার। কেউ হতে চায় মস্ত বৈজ্ঞানিক। চমৎকার হয়েছে। স্বপ্ন দেখতে না জানলে যে বড় হওয়া যায় না ভাই। তবে তোমাদেরই একজন এসবের কিছুই হতে চায় না। তার খাতাটাই পড়ছি আমি।’ বলতে বলতে বান্ডিলের ভিতর থেকে একটা খাতা টেনে নিয়ে তিনি পড়তে শুরু করলেন, ‘আমি বড় হয়ে এক আইসক্রিমওয়ালা হতে চাই।’
মুহূর্তে সারা ক্লাসে হাসির রোল উঠল। হাসলেন মাস্টারমশাইও। তারপর হাসির রোল থামতে গোড়া থেকে শুরু করলেন আবার, ‘আমি বড় হয়ে এক আইসক্রিমওয়ালা হতে চাই। যখন এই শহর গরমে ফুটিফাটা হয়ে উঠবে, দারুণ গরমে আইঢাই করবে মানুষ, পিঠে বাক্সে করে বয়ে আনব এক টুকরো মনোরম জগ, ঠিক স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্নের ছোঁওয়া একটু হলেও তো দেওয়া যাবে কাউকে...।’
ধীরে ধীরে পুরো লেখাটা পড়ে শেষ করলেন তিনি। খাতা থেকে চোখ তুলে তাকালেন, সামনে ছেলেদের দিকে। শেষ বেঞ্চে বসা সেই ছেলেটার মুখ তখন শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। মস্টারমশাই বললেন, ‘দেবজ্যোতি দাস কে?’
দেবজ্যোতি, দেবজ্যোতি? সারা ক্লাস থমকে গেল হঠা। তারপর একসাথে শোরগোল উঠল, ‘ভোম্বল, ভোম্বল স্যার।’
‘কে ভোম্বল?’ বললেন উনি।
ঘাড় নিচু করে কোনওমতে উঠে দাঁড়াল ছেলেটি।
‘মাথা উঁচু কর দেবজ্যোতি।’ বললেন উনি, ‘সেরা লেখাটা কিন্তু তুমিই লিখেছ। দশে দশ নম্বর। আজ থেকে তুমি ক্লাসের মনিটর।’
ততক্ষণে মাথা তুলেছে ছেলেটা। নিজের কানকেও তখন যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। ও দেখতে পারছিল, সারা ক্লাস কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। ফার্স্ট বয় নবেন্দু পর্যন্ত।
‘তা হয় না স্যার। ক্লাসের মনিটর যে নবেন্দু।’ সবাইকে অবাক করে দিয়ে অদ্ভুত দৃঢ় গলায় বলল ছেলেটা।
মৃদু হাসলেন মাস্টারশাই। এগিয়ে এসে পিঠটা চাপড়ে দিলেন ওর, ‘কিন্তু আইসক্রিমওয়ালা হতে হলে আজ থেকে তোমাকে যে ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে হবে দেবজ্যোতি।’
মাথা নাড়ল ছেলেটা। বই–খাতা তুলে নিয়ে গটমট করে হেঁটে বসে পড়ল ফার্স্ট বয় নবেন্দুর পাশে।

ছবি: প্রদীপ গোস্বামী  
৪/৪/১০১৭ 

11 comments:

  1. অসাধারন... অনবদ্য গল্প...

    ReplyDelete
  2. Darun monea pores gelo school er din gulo

    ReplyDelete
  3. খুব ভাল লাগল।

    ReplyDelete
  4. অপূর্ব!!! এই মানবিকতা বেঁচে থাকুক... শিল্পীর কাজ এটাই, মানুষের আবেগ, মনন, মানবিকতাকে জাগিয়ে রাখা...

    ReplyDelete