Wednesday 21 January 2015

চেনা মাটি অচেনা মানুষ (মোবাইল ভার্শন) : বেলপাহাড়ির পথে (শিশির বিশ্বাস)

চেনা মাটি অচেনা মানুষের কথা:
বেলপাহাড়ির পথে
শিশির বিশ্বাস
 পাহাড় ঘেরা বেলপাহাড়ি। শুধু মাত্র পুব দিক ছাড়া যেদিকে তাকাও নজর আটকে যাবে দিগন্তের সীমারেখার কাছে ধুসর রঙের পাহাড়ে। পাহাড় আর জঙ্গল। অবশ্য বেলপাহাড়িতে পাহাড় নেই। উঁচু–নিচু ঢিপি আর বনবিভাগের তৈরি হালকা–পাতলা একটু জঙ্গল। লাল মোরামের রুখো মাটির দেশ।
বেলপাহাড়িতে প্রথম গিয়েছিলাম সেই আটের দশকের মাঝামাঝি। ফরেস্ট বাংলো বুক করে নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়া। তবু তাল কেটে গেল গোড়াতেই। ঝাড়গ্রাম থেকে মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার পথ। অথচ বিকেলের মধ্যে ঝাড়গ্রাম পৌঁছেও এই পথটুকু পাড়ি দিতে লেগে গিয়েছিল সাত ঘণ্টার উপর। অনিয়মিত বাস তখন এই পথে রোজকার ব্যাপার। সন্ধের পরে বাস যদিবা একটা পাওয়া গেল, ঝাড়গ্রামের চৌহদ্দি পেরোতেই হঠাৎ করুণ আর্তনাদে ব্রেকডাউন। কাছেই এক গ্যারেজ থেকে মিস্ত্রি ডেকে শুরু হল মেরামতির কাজ। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটার ঘর ছুঁতে চলেছে, কখন বাস চালু হবে ঠিক নেই। পথের দুই ধারে শুধু ফাঁকা মাঠ। তারই মাঝে দু’একটা বড় আকারের শাল–মহুলের গাছ। সেখানে গা ছমছম করা আরও জমাট অন্ধকার। এছাড়া নিশুতি রাতের অন্ধকারে চারপাশে শুধু ঝিঁঝির কোরাস। অন্ধকারে সেই পথের মাঝে কপালে যখন চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে, নজরে পড়ল এক কোনে বাসের টিমটিমে আলোয় নানা বয়সের কয়েকটি আদিবাসী কচিকাঁচা মুখ। সবচেয়ে ছোটটির বয়স বছর ছয়েকের বেশি নয়। কাঁধে বই–খাতার ব্যাগ। সেই সকালে বাস ধরে ঝাড়গ্রামের স্কুলে পড়তে এসেছে ওরা। এখনও ঘরে ফেরা হয়নি। বোধহয় খাওয়াও জোটেনি তারপর। কিন্তু কারও মুখে ক্ষোভ–অভিযোগ নেই। দিব্যি নিশ্চিন্তে গল্প জুড়েছে। চলছে সেদিনের ক্লাসের পড়া নিয়ে আলোচনা। সত্যি, ওদের সেই মুখগুলো সেদিন কিছুটা হলেও স্বস্তি যুগিয়েছিল। প্রসঙ্গত এর দু’দিন পরে ফেরার পথের কথাও এই ফাঁকে সামান্য না বলে পারা গেল না। দু’দিন পরে রবিবার দুপুরে বাস ধরে ঝাড়গ্রাম ফিরছি। বিনপুর থেকে বছর চৌদ্দ বয়সের একটি ছেলে উঠল। পাশে এসে দাঁড়তে সরে সামান্য জায়গা করে দিয়েছিলাম। তারপরেই আলাপ। জানাল, বিকেলে ঝাড়গ্রামে ডিসট্রিক্ট টুর্নামেন্টের ফুটবল ম্যাচ। তাই দেখতে চলেছে। বিনপুর থেকে ঝাড়গ্রামের দূরত্ব কম নয়। আসবার দিনের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়তে বললাম, ‘খেলা দেখে কখন বাড়ি ফিরবে?’
ছেলেটি অম্লান বদনে বলল, ‘এদিকে বাসের অবস্থা ভাল নয় সার। রাত দশটা–এগারোটাও হয়ে যেতে পারে। তেমন হলে ঝাড়গ্রাম স্টেশনেও রাত কাটাতে হতে পারে।’
সামান্য ডিসট্রিক্ট টুর্নামেন্টের ম্যাচ। তাই দেখতে এমন ঝুঁকি! অবাক হয়ে সেই কথা বলতে ছেলেটি অম্লান বদনে বলল, ‘এসব ম্যাচ না দেখলে কী করে শিখব সার।’
ছেলেটি যে ফুটবল অন্ত প্রাণ, প্রকাশ পেতে দেরি হয়নি তারপর। খুব ইচ্ছে কলকাতার কোনও ফুটবল ক্লাবে খেলার। ওদের এদিকে ফুটবলারের খোঁজে কলকাতা থেকে কখনও স্পটার আসেন। যদি তাঁদের নজরে পড়া যায়, ছেলেটির চোখে সেই স্বপ্ন।
আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবার। সেদিন আমরাও বেলপাহাড়ি পৌঁছেছিলাম রাত প্রায় বারোটা নাগাদ। নিশুতি রাতে বাস থেকে নেমে অন্ধকার নির্জন বনপথ ধরে ফরেস্ট বাংলোর দিকে হাঁটার সময় নাকে আসছিল শুধু ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধ। বেলপাহাড়ির বাতাসে ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধই শুধু নয়, অন্য এক গন্ধও পাওয়া যায় কখনও। ব্যাপারটা জানা গিয়েছিল বৃদ্ধ বনমালি সোরেনের কাছে। ‘আর কদিন পরেই চৈত মাসে বাতাসে অন্য এক গন্ধ দিবে বাবু। সিটো মহুয়া ফুলের সময় বটে।’
বেলপাহাড়িতে মহুয়া গাছের অভাব নেই। চৈত্র মাস পড়লেই তাই গ্রামে গ্রামে সাড়া পড়ে যায়। প্রতিটি গাছের তলা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে রাখা হয়। মহুয়া ফুলের আয়ু মাত্র একটি রাত। সন্ধেয় ফোটা ফুল সকালেই ঝরে যায়। তখন কুড়িয়ে নেবার পালা। মহুয়া ফুলের লোভে কাছে বাঁশপাহাড়ি আর কাঁকড়াঝোরের জঙ্গল থেকে তখন দু’একটা ভালুকও নাকি চলে আসে কখনও। 
মহুয়া, ইউক্যালিপ্টাস ছাড়াও বেলপাহাড়িতে আর রয়েছে সোনাঝুরি। এছাড়া শাল, সেগুন আর পিয়াল। এখানে ওখানে ডাঁই করা কাঠের পাহাড়। ভোর সকালে বাজারে এলেই নজরে পড়বে কাঠ বোঝাই হয়ে সার সার গরুর গাড়ি আসছে পাহাড়ের ওদিকে জঙ্গলের দিকে থেকে। জমা হচ্ছে মহাজনের গুদামে। আর রয়েছে বনমালি সোরেনদের গ্রামগুলো।
বনমালি সোরেনরা কালো মানুষ। অথচ ওদের ঝকঝকে ঘরবাড়িগুলো চোখে পড়ার মতো। নিখুঁতভাবে নিকানো মাটির দেয়াল, উঠোন মায় গোয়ালঘরটি পর্যন্ত। এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বোধ হয় ওদের মজ্জাগত। রবিবার ছুটির দিন। বেলপাহাড়ি আদিবাসী আবাসিক স্কুলের মেয়েদের দেখলাম হাতে ঝাঁটা, ঝুড়ি আর বালতি নিয়ে কাজে নেমে পড়েছে। শুধু স্কুলবাড়িই নয়, পরিষ্কার করে ফেলছে আশপাশের জমা জঞ্জালও। কলকাতা শহরেও হয়তো এমন দৃশ্য দেখা যায় কখনও। নামি কোনও স্কুল বা সংস্থার ছেলেমেয়েরা ঝকঝকে পোষাকে বুকে ব্যাজ আর হাতে পোস্টার, ব্যানার নিয়ে সহর সাফাইয়ে বের হয়। খবর দিয়ে আনা হয় রিপোর্টার আর ক্যামেরা ম্যান। পরের দিন দৈনিক পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয় সেই ছবি। দেখানো হয় টিভির চ্যানেলে। সঙ্গে চটকদার ভাষ্য।
বেলপাহাড়ির গ্রামের পথে হাঁটলেই নজরে পড়বে উঁচু লম্বা গলা আর বেজায় লম্বা পায়ের কিছু অন্য জাতের মুরগি। চরে বেড়াচ্ছে গ্রামের পথে। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলে জানা যাবে লাল মাটির এই অঞ্চলের এক অতি জনপ্রিয় খেলা মোরগের লড়াইয়ের কথা। লম্বা গলা আর পা ওয়ালা এই জাতের মোরগ দারুণ লড়িয়ে। এদের কদর তাই এখানে ঘরে ঘরে। শীত পড়লেই শুরু হয় মোরগের লড়াই। হাটে, বাজারে কিংবা মাঠে–ময়দানে তখন সমানে চলবে এই খেলা। দুটো মোরগের লম্বা পায়ে তীক্ষ্ণ ছুরি বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হবে। চারপাশে হরেক দর্শকের হইহই ভিড়। লড়াইয়ের হাল দেখে ওঠানামা করবে বাজির দর। লড়াই শেষে পরাজিত মোরগটি হবে বিজয়ী মোরগের মালিকের সম্পত্তি। এছাড়া মোট বাজির টাকার কিছু অংশ। এছাড়া বাজিতে যাদের জিত হল তাদের সহর্ষ জয়গান আর সাধুবাদ বাড়তি প্রাপ্য। আর যে মোরগের হার হল, তার মালিক লজ্জায় মুখ লুকোবেন। বাজিতে যাদের হার হয়েছে, তাদের টিটকিরি আর কটু কথা তো আছেই।
ঝাড়গ্রামের অদূরে কুসুমডাঙার মেলা এই মোরগের লড়াইয়ের জন্য বিখ্যাত। মেলার পাঁচদিন সমানে চলে মোরগের লড়াই। দূর থেকে আদিবাসী মানুষেরা তাদের সেরা মোরগ নিয়ে আসে। মোরগের লড়াই এই অঞ্চলে প্রায় জাতীয় উৎসবের মতো।
বেলপাহাড়ির কেন্দ্রবিন্দু সড়কের পাশে ছোট এক বাজার। দু’ধারে মাটির ঘর। তারই মাঝে গোটা কয়েক পাকা বাড়ি। ষ্টেশনারী, মুদি আর কাঁচা আনাজের দোকান। জলখাবারের দোকানে ভোর সকালেই ব্যস্ততা। কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় গরম তেলেভাজা আর মুড়ি। সকালের জলযোগ। ভিতরে ঢুকলে তীব্র ঝাঁঝালো আর মিষ্টি অন্য এক গন্ধও নাকে আসবে। মহুয়ার দেশি মদের খদ্দের জুটে গেছে এই ভোর সকালেই। হাতে হাতে কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় সেই পানীয়। পেটে কয়েক ঢোঁক চালান দিয়ে শুরু হবে দিনের কাজ। শেষ বিকেলে ঘরে ফেরার পথে ফের আর এক প্রস্থ।
বাজারের পিছনে পুরনো দিনের নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। নীল ভেজাবার জন্য তিন ধাপে ছয় সারিতে আঠারোটা ভাঙাচোরা চৌবাচ্চা সেই পুরনো দিনের সাক্ষ্য বহন করে টিকে আছে এখনও। বৃদ্ধ বনমালি সোরেনের কথায়, ‘ইখানে ত বাবু এক সময় জঙ্গল ছিল। ইয়ার পর সাহেবরা জঙ্গল সাফ করল। ক্ষেতি বানাইল। কুঠি হইল। শুরু হইল নীল চাষ। মোদের কপালটাও পুড়ল।’
সাহেবরা এখন আর নেই। নীলচাষও হয় না। তবে তাতে বনমালি সোরেনদের কপাল ফেরেনি। সাহেবরা বিদায় নিলেও ওদের সেই সবুজ অরণ্য আর ফিরে আসেনি। রয়ে গেছে সেই খেত। লালমাটির রুক্ষ এক ফসলি জমি। ওই বর্ষার সময় সামান্য ধান ছাড়া সেই মাটি বনমালিদের আর কিছু দিতে পারে না। বেলপাহাড়ির চারপাশে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে সবুজের কোনও চিহ্ন আমার নজরে পড়েনি। সবে ফাল্গুন মাস। গোটা কয়েক পুকুরে শেষ তলানি লালচে খানিকটা জল টিকে আছে কোনওমতে। কদিন পরে এটুকুও থাকবে না।
বাজারে আনাজ বলতে শুকনো বাঁধাকপি, বেগুন, চালানি আলু আর মার্বেল সাইজের আধপাকা টম্যাটো। সকালের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বৃদ্ধ বনমালি সোরেন বাজারের এক কোণে বাঁধাকপি পাতার গোটা কয়েক ছোট আঁটি সাজিয়ে বসে আছে। ঘন সবুজ রঙের বাতিল পাতা। কলকাতার বাজারে ছুঁড়ে ফেলা হয় ডাস্টবিনে।
‘এগুলো বিক্রি হয় এদিকে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতে আরও অবাক হয়ে বৃদ্ধ মানুষটি বলল, ‘কেনে গো বাবু! খুব মিঠা ত!’

আমার সামনেই গোটা কয়েক আঁটি বিক্রি হয়ে গেল। নাহ্‌, নিজের দেশটার প্রায় কিছুই জেনে উঠতে পারিনি এখনও।

No comments:

Post a Comment