Saturday 3 January 2015

ছেলেবেলার ভাললাগা গল্প (মোঃ ভাঃ) : উইয়ের ঢিবি (ধীরেন্দ্রলাল ধর)



রাত্রির অন্ধকার। আসামের পাহাড়ি অঞ্চল। মণিপুরের প্রায় বিশ মাইল দূরে গভীর জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্যভূমি। একটি টিলার মাথায় বড়ো একটি খুঁটির উপর ছোটো একখানি ঘর। ঘরের সামনে এক ফালি ঝুলবারান্দা। সেই বারান্দায় বেতের দু’খানি চেয়ারে চুপ করে বসে আছে রণজিৎ ও বিশ্বনাথ। রণজিৎ এখানকার ফরেস্টার আর বিশ্বনাথ মিলিটারি রক্ষী। দু'জনেরই হাতের কাছে দু'টি বন্দুক, দেয়ালের গায়ে দাঁড় করানো আছে। রণজিতের কোলের উপর একটি বাইনোকুলার। রণজিতের এখন কাজ হল, দিনে-রাতে লক্ষ্য রাখা, কোথাও মশাল জ্বললে বা নাগাদের কোনোরকম সন্দেহজনক গতিবিধির সংবাদ পেলেই ইমফলের হেড কোয়ার্টারে খবর দেওয়া। নাগা বিদ্রোহীরা এই অঞ্চলে বহু উৎপাত করে গেছে, ভারত সরকার তার প্রতিকার চান।
মাত্র কয়েকদিন রণজিৎ এখানে এসেছে, এর মধ্যেই এই কাজ তার দুঃসহ হয়ে উঠেছে। পাঁচ বছর ছিল বাদামি পাহাড়ে। সেখানে রাতে আলো জ্বালার বাধা ছিল না। ওঁরাওদের সঙ্গে বসে বসে গল্প করা চলত, কোনো সময়েই একটা শঙ্কিত ভাব নিয়ে চলতে হত না। আর এখানে সদাই শঙ্কা, রাতে আলো জ্বালতে ভয় করে। আলো লক্ষ্য করে দূর থেকে গুলি চালানোর সুবিধা। গাঁয়ে গিয়ে নাগাদের সঙ্গে আলাপ করার সুবিধা নেই, তাদের কথা বোঝা যায় না। বিশ্বনাথ ছাড়া দ্বিতীয় সঙ্গী নেই।
দিনের চেয়ে রাতে ভয় বেশি, তাই রাত্রেই যতটা সম্ভব জেগে কাটায়, তারপর দুজনে পালা করে জাগে। তাও জাগা বললেই জাগা, সব সময় কানের পাশে মশা বোঁ বোঁ করছে। সর্বাঙ্গ ঢেকে বসে থাকতে হবে। হাত পা কোনোখানে এতটুকু ফাঁক রাখার জো নেই, নাইলনের বড়ো রুমাল দিয়ে মাথা থেকে ঢেকে রাখে গলা অবধি। তাতে দেখতে কোনো বাধা হয় না। এভাবে রাতের পর রাত বসে থাকা যে কি কষ্ট, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বোঝে না।
সেদিন গরমটা একটু বেশি পড়েছিল। সহজে ঘুম আসার কথা নয়, তবু রণজিৎ বিশ্বনাথকে বলল তুমি এখন একটু ঘুমিয়ে নাও, রাত দু'টো নাগাদ আমি তোমাকে তুলে দেব’খন।
সেইখানেই একখানি চাটাই বিছিয়ে বিশ্বনাথ সর্বাঙ্গে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। রণজিৎ অকারণেই বাইনোকুলারটা চোখে ধরে অন্ধকার জঙ্গলের পানে তাকিয়ে রইল। ইতিমধ্যে নবমীর চাঁদ দেখা দিল গাছের মাথায়। চাঁদের আলোয় বনভূমির ভয়াল অন্ধকার স্নিগ্ধ ছায়াময় হয়ে উঠল। চাদের পানে তাকিয়ে রণজিৎ কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল।
কোনো এক সময় রণজিতের মনে হল নিচে বনভূমির মধ্যে কালো মতো কি যেন একটা নড়ছে। ভালুক বেরুল নাকি? কিন্তু ভালুক চলাফেরা করলে অমনভাবে তো চোখে পড়বে না। ছায়াটা যেন খুব বড়ো বলে মনে হয়। কোনো হাতি দল থেকে ছিটকে এল নাকি? রণজিৎ ভালো করে তাকাল, বাইনোকুলারটি চোখে লাগাল কিন্তু ভালো করে কিছুই ঠাহর করতে পারল না।
—কোই হ্যায়? একটা অস্ফুট কণ্ঠ শোনা গেল। রণজিৎ কান খাড়া করল।
—ঘরমে কোই হ্যায়?
—কে? কেয়া মাংতা?
—খাবার আছে—খাবার?
—কে তুমি? কাছে এসো। রণজিৎ তাকে কাছে ডাকল বটে, কিন্তু নিজে উঠে বারান্দার ধারে এসে দাঁড়াল না। কে কিছু তো জানা নেই, সামনে পেলে যদি গুলি চালায়। এমন ঘটনা এখানে ঘটেছে। গোড়া থেকেই সাবধান হওয়া ভালো।
—কাছে, না না, বেশি কাছে আমি যাব না।
—কেন, কাছে আসতে ভয় কি?
—কাছে এলে তুমি ভয় পাবে।
—ভয় পাব?
-হ্যা, ভয় পাবে। আমায় কিছু খাবার দাও, আমি চলে যাই। আমার বড়ো খিদে পেয়েছে।
–বেশ তো খাবার তোমাকে দিচ্ছি, কিন্তু তুমি কে? কাছে না এলে খাবার নেবে কি করে?
—এই জঙ্গলের দিকে ছুড়ে দাও, আমি কুড়িয়ে নেব। রুটি দাও, রুটি।
বিশ্বনাথের ঘুম ভেঙে গেল, বলল কি হয়েছে?
—কে একজন এসে খাবার চাইছে।
—কে?
—অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
বিশ্বনাথ ধড়মড় করে উঠে পড়ল, টর্চটা তুলে নিয়ে আলো ফেলল সামনে জঙ্গলে। ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না। বলল কেউ কোথাও তো নেই।
—আমি এখানে আছি, খাবার দিয়ে দাও, আমি চলে যাই।
বিশ্বনাথ চমকে উঠল। রণজিৎ বলল তুমি ওখানে আছ?
—আছি, খাবার দাও।
—বিশ্বনাথ একখানা রুটি এনে দাও তো, একটু মাখনও দিও।
—কেউ কোথাও নেই কাকে রুটি-মাখন দেব! বিশ্বনাথ প্রতিবাদ তুলল।
—তুমি দাও না, দেখি।
ঘরের ভিতর থেকে বিশ্বনাথ রুটি-মাখন নিয়ে এল। এক পাউন্ড রুটি আর দু’আউন্স মাখন কাগজে জড়িয়ে রণজিৎ ছুড়ে দিল সামনের গাছগুলির নিচে। বলল এই নাও, রুটি আর মাখন।
—মাখন? ওঃ! অনেকদিন মাখন খাইনি, তোমাকে ধন্যবাদ!
ঠিক সেই সময় বিশ্বনাথ আবার টর্চের আলো ফেলল সামনের বনভূমির মধ্যে। কোথাও কেউ নেই! এবার সে ঘরের নিচে আলো ফেলল, মেঝেতে কয়েকটা ফুটো করা ছিল, বলল দেখুন তো নিচে কেউ আছে কিনা।
রণজিৎ ফুটোয় চোখ রেখে নিচে তাকাল, আলোর অভাবে কাউকে চোখে পড়ল না। বিশ্বনাথ বলল কেউ কোথাও নেই, এ জিন, রাতে ভয় দেখাচ্ছে।
—জিন নয়, জিন নয়, আমি মানুষ, আমি আছি এখানে।
—তাহলে তোমায় দেখতে পাচ্ছি না কেন? রণজিৎ বলল।
—দেখতে পেয়েছ, কিন্তু চিনতে পারনি।
—তার মানে?
—আলো নিভিয়ে দাও, সব বলছি। আগে রুটি আর মাখনটুকু নিয়ে নিই।
—আলোয় এসেই নাও না?
—না, আমায় দেখলে তোমরা ভয় পাবে। আলো নিভিয়ে দাও।
রণজিৎ বিশ্বনাথকে ইশারা করল। বিশ্বনাথ আলো নিভিয়ে দিল।
গাছের ছায়ায় ছায়ায় বনভূমি অন্ধকার। তবু চাঁদের আলোর অস্ফুট আভাসে দেখা গেল, একটা প্রকাণ্ড ছায়ামূর্তি বনভূমির কিনারায় এগিয়ে এল। কুড়িয়ে নিল রুটি-মাখনের মোড়কটা। বিশ্বনাথ ভয়ে কেঁপে উঠল, ফিসফিস করে বলল দেখছেন বাবু জিন!
ছায়ামূর্তি সরে গেল বনের কিনারায়।
—কই চলে যাচ্ছ যে, কিছু বললে না? রণজিৎ হাক দিল।
—কি বলব?
-তুমি কে? কোথা থেকে আসছ?
—আমি আজাদ হিন্দের সৈনিক। আমার নাম তুকারাম, পুনায় আমার বাড়ি, রেঙ্গুনে গিয়েছিলাম ব্যবসা করতে।
—তা এখন তো দেশে ফিরে গেলেই পারো। কবে লড়াই শেষ হয়ে গেছে।
—দেশে ফেরার আর উপায় নেই। যতদিন বাঁচব এই বনেই আমাকে থাকতে হবে।
—কেন ব্যাপারটা কি বলো তো?
—শুনলে কি বিশ্বাস করবে?
—আহা, বলোই না।
—তবে শোনো। আমি আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলাম। লড়তে এসেছিলাম মণিপুরে। কয়েকখানি গ্রাম দখল করে যখন আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তখন তো লড়াই গেল থেমে। তখন ধরা পড়লে আমাদের বিচার হবে, জেল হবে, নয়তো গুলি খেয়ে মরতে হবে, এই সব ভেবে আমরা জঙ্গলের মধ্যে গা-ঢাকা দিলাম। এক সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে থাকলে সহজেই শত্রুপক্ষের চোখে পড়ার সম্ভাবনা, তাই আমরা দুজন একজন করে ছড়িয়ে পড়লাম। আমরা দু'জনে ছিলাম এক সঙ্গে আমি আর আমার বন্ধু দীনদয়াল। একাদিক্রমে সাতদিন জঙ্গলে ঘোরার পর আমরা শেষে একটি গুহা পেলাম। বেশ প্রশস্ত গুহা, সামনে কয়েকটা ফলের গাছ। কাছেই একটা ঝরনা আছে। আমরা স্থির করলাম ওইখানেই আমরা কিছুকাল গা-ঢাকা দিয়ে থাকব! ফল ও জলের তো কোনো অভাব হবে না।
সেইখানেই আমরা রয়ে গেলাম। স্থানটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাসোপোযোগী করে নিলাম। ফল ও জলের কোনো অভাব ছিল না। আমরা বেশ স্বচ্ছন্দেই রয়ে গেলাম সেখানে। দিন পনেরো অতিবাহিত হবার পর হঠাৎ একটা অভাবিত উপসর্গ দেখা দিল। হাত-পা চুলকোতে শুরু করল। প্রথমে কিছু মনে করিনি। সাত-আট দিনের মধ্যে দেখি হাত-পায়ের লোমগুলি সবুজ হয়ে যাচ্ছে। অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু সেই বিস্ময়ের ভাবটুকু কাটিয়ে ওঠার আগেই দেখি আমাদের মাথার চুল অবধি সবুজ হয়ে গেছে। এবার আমরা ভয় পেলাম! কিন্তু আজাদ-হিন্দের পলাতক সৈনিক আমরা, সেই নিরাপদ গুহা ছেড়ে বাইরে বেরুতে সাহস পেলাম না। এদিকে ধীরে ধীরে আমাদের পায়ের লোমগুলি মোটা মোটা হয়ে ঘাসের মতো হয়ে উঠল। দেখতে দেখতে আমাদের সর্বাঙ্গ সবুজ ঘাসে ঢাকা পড়ে গেল! আমরা যে মানুষ, এ কথা এখন আমাদের পানে তাকালে আর বোঝা যায় না। আমরা যদি মাঠের মাঝে চুপ করে শুয়ে থাকি, তাহলে আমাদের ঘাস ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না।
—তোমরা নগরে গিয়ে চিকিৎসা করালে তো পারো।
—এর কোনো চিকিৎসা হয় না। আমরা পরস্পরের গা থেকে এক-একটি লোম ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি, সারা দিন ধরে শুধু গা পরিষ্কার করেছি, কিন্তু মূলগ্রন্থিগুলো তো আর উপড়ে ফেলতে পারিনি, ধীরে ধীরে আবার সেইখানে ঘাস গজিয়ে উঠেছে। এর কোনো প্রতিকার বা চিকিৎসা হয় বলে আমাদের মনে হয় না। এ এক অভাবনীয় রোগ, ক্লোরোফিল রোগ। গাছ-পাতার ক্লোরোফিল গায়ে এসে জমছে।
—এমন ব্যাপার তো শোনা যায় না।
—এই অঞ্চলে যখন মানুষ বাস করবে, তখন হয়তো এই রোগ ধীরে ধীরে ছড়াবে, তখন ওষুধও বেরুবে, এখন আমাদের নীরবে ভোগা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এই রকম চেহারা নিয়ে যদি আমরা লোকালয়ে যাই, তারা আমাদের জানোয়ার মনে করে মেরে ফেলবে। তাই আমরা এখানেই আছি। তবে একটা ভালো হয়েছে, খিদে-তেষ্টা আমাদের আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। একটা ফল আর এক আঁজলা জল খেলেই আমাদের এখন দিন কেটে যায়। হঠাৎ বন্ধুর শখ হল রুটি খাবার, তাই তোমাদের কাছে এলাম। তুমি রুটি দিয়েছ এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
—আমার গাড়ি আছে, তোমরা যদি শহরে যেতে চাও চিকিৎসার জন্য, সে ব্যবস্থা আমি করতে পারি।
—না থাক! ধন্যবাদ!
বিশ্বনাথ চুপ করে এতক্ষণ শুনছিল এবার সহসা সে টর্চের আলো ফেলল। দেখা গেল, একটা সবুজ রঙের প্রকাণ্ড ছায়া দ্রুত বনের মধ্যে চলে যাচ্ছে। যেন একটা গাছ চলছে। অত লম্বা মানুষ হয় না। বিশ্বনাথ বলল ও মানুষ নয়, বাবু, জিন!
—তাই হবে হয়তো।
পরদিন সকালে ভিজে মাটির উপর বড়ো বড়ো পায়ের দাগ দেখা গেল। এক একখানি পা প্রায় আঠারো ইঞ্চি লম্বা। তার ফটো দেখে খবরের কাগজওলারা লিখল এ সেই হিমালয়ের তুষার-মানবের পদচিহ্ন!
রণজিৎ সে খবর পড়ল, কিন্তু কোনো বিবৃতি বা বাদ-প্রতিবাদে সে লিপ্ত হল না। কদিন পরে আবার এক রাতে ঠিক সেই সময় সেই কণ্ঠ শোনা গেল কর্তা, জেগে আছেন? হ্যালো হ্যালো—
—কে? রণজিৎ সাড়া দিল।
—আমি আবার এসেছি, কিছু খাবার দেবেন? রুটি?
—দাঁড়ান, দেখছি।
বিশ্বনাথকে ইঙ্গিত করতে সে ভিতরের ঘর থেকে রুটি নিয়ে এলো। বললো মাখন নেই। কাগজে মুড়ে রুটিখানি রণজিৎ বনের কিনারায় ছুড়ে দিল, বলল এই নিন আজ আর মাখন নেই।
—ধন্যবাদ, অজস্র ধন্যবাদ, আপনাকে এভাবে বার বার বিরক্ত করছি বলে আমি লজ্জিত।
—কিন্তু একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, এভাবে আপনারা আর কতদিন চালাবেন, লড়াই তো অনেক কাল থেমে গেছে, আপনারা ফিরে চলুন না।
—বলেছি তে যাবার উপায় নেই! এক-গা ঘাস নিয়ে কি কোথাও যাওয়া যায়?
—ওটা তো রোগ, চিকিৎসা করলেই সেরে যাবে।
—এ মৃত্যুবরাগ, এর কোনো চিকিৎসা হয় না।
—চিকিৎসা হয় কি হয় না, সেটা কোনো ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ না করে কি করে বুঝছেন?
—আমার সঙ্গীটিই যে ডাক্তার, এল এম এফ।
—এবার যেদিন আসবেন, তাকেও সঙ্গে করে আনবেন আমি কথা বলব। সে যে চলতে পারে না, তার পায়ের অসুখ। আচ্ছা, আমি তাহলে আসি, জয় হিন্দ!
বনের মধ্যে ছায়াটি অদৃশ্য হয়ে গেল। সেদিন বোধহয় পূর্ণিমা ছিল, চাদের আলোয় তাকে ভালোই দেখা গেল, কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। রণজিৎ বলল বিশ্বনাথ, লোকটার অনুসরণ করে দেখলে কেমন হয়।
—এত রাত্রে, এই বনের মধ্যে? আপনি যান, আমি যাব না।
—বন্দুক তো রয়েছে।
—দু'টো বন্দুকে কি হবে? যদি দু’শ লোক আমাদের ঘিরে ধরে, কি একটা হাতির পাল এসে পড়ে? এখানে যা কিছু করতে হবে দিনে দিনে।
কথাটা অযৌক্তিক নয়। রণজিৎ বলল বেশ, কাল সকালে একবার ওদিকটা ঘুরে দেখতে হবে। পরদিন সকালে বিশ্বনাথকে সঙ্গে নিয়ে রণজিৎ বেরিয়ে পড়ল।
সামনে বন্ধুর পার্বত্য বনভূমি। কোথাও এতটুকু জায়গা বোধহয় সমতল নেই, উঁচু-নিচু ঘোর-ফের অনেক। তারপর আবার ঘন গাছের সারি। বিশ হাত দূরে বিশজন মানুষ যদি লুকিয়ে থাকে তো বোঝা যাবে না। একবার সে বনভূমির মধ্যে প্রবেশ করলে পথ ঠিক রেখে বেরিয়ে আসা কঠিন। এর মধ্যে কোথায় যে সেই লোক দুটি আছে, কে বলবে!
কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করার পর বিশ্বনাথ বলল এখানে কাকে খুঁজবেন বাবু, কোথায় খুঁজবেন?
রণজিৎ ফরেস্টার, বনে-জঙ্গলে ঘোরা তার অভ্যাস আছে। বলল একবার ভালো করে চারপাশটা দেখে যাই, লোকটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও থাকে।
অনেক কষ্টে গাছপালাকে পাশ কাটিয়ে রণজিৎ আরও কিছুটা অগ্রসর হল। সামনেই একপাশে একটি টিলা। রণজিৎ গিয়ে উঠল সেই টিলার মাথায়। টিলার পিছনেই একটা গুহা দেখা গেল, পাশেই একটি ঝরনা। বিশ্বনাথ ও রণজিৎ সেই টিলা থেকে নেমে সেই গুহার মধ্যে ঢুকল।
গুহার মধ্যে ঢুকেই দু’জনে চমকে উঠল। দু'টি লোক গুহার মধ্যে শুয়ে আছে। রণজিৎ চিৎকার করে উঠল হ্যালো! হ্যালো!
কিন্তু মানুষ দু'টির কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
আরও কাছে গিয়ে রণজিৎ অবাক হয়ে গেল! এদের মানুষ বলে মনে হয় বটে, কিন্তু এরা তো মানুষ নয়। ঠিক মানুষের আকারে দু'টো উইয়ের ঢিবি। ঢিবির উপর মাটির পলি পড়েছে, ছোটো ছোটো ঘাস জন্মে গেছে। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, দু'টো মানুষকে উইয়ে খেয়েছে। তবু নিজের চোখকে রণজিৎ পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না, হাতের লাঠিগাছটা দিয়ে একটু নাড়া দিতে গেল! লাঠিগাছটি যেখানে লাগল, উইয়ের ঢিবির মাটির গুঁড়ো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ল। ব্যাপারটা কি হল? রণজিৎ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল বিশ্বনাথের পানে। বিশ্বনাথ বলল বাবুজি আর দরকার নেই, ফিরে চলুন। আমি তো বলেছি মানুষ নয় জিন।
রণজিৎ জীবনে এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়নি। কিছুটা সে ভয় পেয়েছিল সত্য, তবু মনের সেই শঙ্কাটুকু চাপা দেবার জন্য বলল এরা বোধহয় আই এন-এর কোনো সৈন্য হবে, এখানে মারা গেছে, তারপর উই ধরেছে।
—মরে গেছে, তাহলে আপনার কাছে রুটি চাইতে গেছে কে?
এ একটা রহস্য। তবু রণজিৎ বলল যাই হোক, এদের একটা সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে।
বনের মাঝেই ক্রোশখানেক দূরে একখানি গ্রাম ছিল। পরদিন সকালে রণজিৎ সেখান থেকে জন বারো লোককে ধরে আনল, একটা গাছ কেটে ওই উইয়ের ঢিবিগুলির সে অগ্নিসৎকার করবে। কিন্তু সেই গুহার মধ্যে ঢুকে সে অবাক হয়ে গেল, গুহাটি শূন্য। কোথাও কিছু নেই, গতকাল লাঠির আঘাতে উয়ের ঢিবির যে গুড়া মাটিগুলি ঝরে পড়েছিল, তাও নেই! রণজিৎ অবাক হয়ে তাকাল বিশ্বনাথের মুখের পানে। বিশ্বনাথ মাথা নেড়ে বলল—আমি তো বলেছিলাম বাবু, ওরা জিন।
রহস্য রহস্যই রয়ে গেল, তারা ফিরে এল। তবে, তারপর আর কোনো রাত্রে আর কোনো লোক খাবার চাইতে আসেনি।
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত

No comments:

Post a Comment