ছেলেবেলার ভাললাগা গল্প:
হাতি
প্রমথনাথ বিশী
নূতন
আইনের বলে সরকার যাবতীয় জমিদারী বাজেয়াপ্ত করিয়া লইলেন।
সদর
হইতে হাকিম ভাঙাকলসী গ্রামের জমিদার বাবুর কাছারীতে আসিয়াছেন কাছারীবাড়ী দখল
লইবার জন্য। কাছারীর মধ্যে প্রকাণ্ড ফরাসের উপরে জমিদার দক্ষিণাবাবু, হাকিম
সামন্ত সাহেব, নায়েব
ও অন্যান্য কর্মচারিগণ উপবিষ্ট। দক্ষিণাবাবু বিমর্ষ, নায়েব প্রভৃতিও কর্তব্যবোধে বিমর্ষ।
সামন্ত সাহেবের মুখে সমবেদনা প্রকাশের চেষ্টা।
সামন্ত
সাহেব বলিলেন— দক্ষিণাবাবু, আপনার
অবস্থা আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমরাও তো ছোটখাটো একটা জমিদার ছিলাম, ঘুষখোরের
সরকার সব বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে।
সরকারের
চাকুরেগণ সুযোগ পাইলেই সরকারের নিন্দা করিয়া নিজের মর্যাদা ও স্বধীনতা প্রকাশ
করিয়া থাকেন। আর সামন্তের জমিদারী পৌরাণিক আমলে হয়তো ছিল‚ ঐতিহাসিক
কালে কেহ তাহার সাক্ষাৎ পায় নাই।
দক্ষিণাবাবু
বলিলেন‚ সরকারের দোষ দিয়ে লাভ নেই, দেশের লোকই তো দাবী করেছিল। তবু
মন্দর ভালো এই যে‚ সরকার জমিদারী ও কাছারী বাড়ী প্রভৃতি নিয়েই ক্ষান্ত
হয়েছে, বসতবাড়ীটা
সুদ্ধ টান মারেনি।
সামন্ত
একবার এদিক ওদিক দেখিয়া লইয়া গলা নীচু করিয়া বলিলেন বসতবাড়ীও বাদ যাবে না, সমস্ত ধরে
টান মারবে, ঐ
যে বললাম— আগাগোড়া
ঘুষখোরের দরবার।
আগাগোড়ার
মধ্যে সামন্তর মত সরকারী কর্মচারী পড়ে কিনা এ প্রশ্ন কাহারো মনে উঠিল না।
প্রসন্ন
পাল নায়েব। জমিদারবাবু ও হাকিম সাহেব দু'জনকেই খুশি রাখিবার আশায় একবার
নড়িয়া বসিয়া বলিল,
নিশ্চয় নিশ্চয়! তাহার বিশ্বাস ঐ দুটি শব্দে লাঠি না ভাঙিয়া সে সাপ মারিয়াছে, জমিদার রাগ
করেন নাই, হাকিম
খুশী হইয়াছেন।
দক্ষিণাবাবু
বলিলেন, আর
দুঃখ করে লাভ নেই। কাছারী সংক্রান্ত সব জিনিস—খাতা-পত্র, সিন্দুক, বন্দুক সব
মিলিয়ে নিন। দাও, প্রসন্ন, হাকিম
সাহেবকে সব বুঝিয়ে দাও।
সামন্ত
বলিলেন, ওর
আর বোঝাবুঝি কি, আপনার
মতো মহাশয় ব্যক্তি কি আর মিথ্যা হিসাব দাখিল করবেন। নায়েববাবু যা দেবেন আমি চোখ
বুজে সই করে দেব।
সে
আপনার দয়া। জমিদারবাবু বলিলেন, সামন্ত সাহেব মধ্যাহ্নভােজনটা কিন্তু আমার বাড়ীতেই— অবশ্য যদি
আপনার আপত্তি না থাকে।
বিলক্ষণ।
আপত্তি ? আপত্তি
কিসের? আমি
ওসব জাতভিৎ মানিনে, তা
ছাড়া মহাশয় তো আমাদের স্বজাতি।
বিশেষ
আপ্যায়িত হ'লাম।
আমি তা হলে এবারে উঠি। বলিয়া দক্ষিণাবাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
ও
হাতিটা কার? অদূরে
নদীর ধারে একটা হাতি দেখা গেল।
এই
গরীবেরই—
সামন্ত
একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন,
প্রসন্নবাবু তবে ওটাও তালিকায় ধরুন।
দক্ষিণাবাবু
বলিলেন, মাতুর
সঙ্গে জমিদারীর সংস্রব নেই। ওটা আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি, কিংবা আরো
সত্য করে বলতে গেলে বলা উচিত— ওটি আমার কন্যা বিন্ধ্যবাসিনীর সম্পত্তি। অন্নপ্রাশনের
সময়ে তার মাতামহ তাকে ওটি দিয়েছিলেন।
হঠাৎ
কৰ্তব্যভারে পীড়িত সামন্ত সাহেবের মুখ গম্ভীর হইল, তিনি বলিলেন, আরো সত্য
করে বললে কি দাঁড়াবে কে জানে।
আমার
শ্বশুরের লিখিত চিঠি দেখাতে পারি।
বিচার
করবার ভার আমার উপরে নেই,
প্রয়োজন হলে আদালতে দেখাবেন।
কোন
রকমেই কি ওটাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না?
সামন্ত
হাসিয়া বলিলেন, সে
রকম অফিসার তো আমি নই,
আসতো বোস‚ আপনার কিছু ভাবনা ছিল না, কিছু খেয়ে ছেড়ে দিয়ে যেতো। হাজার হোক
‘অনেস্টি’ বলে একটা কিছু আছে তো।
আগাগোড়া
ঘুষখোর সরকারের একজন কর্মচারী অন্তত নির্লোভ ও সাধু জানিয়া দক্ষিণাবাবুর যে পরিমাণ
আনন্দিত হওয়া উচিত ছিল,
তেমন আনন্দিত হইলেন বলিয়া মনে হইল না।
দক্ষিণাবাবু
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, একটি দীর্ঘনিঃশাস ছাড়িয়া বলিলেন‚ তা বটে।
সবই যখন গেল ওটাকে রেখে আর কি করব, তা ছাড়া এখন হাতির খোরাক জোগাবো কি
করে? নিয়ে
যান, তবে
একটা অনুরোধ‚ কয়েকটা দিন পরে নেবেন।
কৌতুহলী
সামন্ত শুধাইলেন, কেন
বলুন তো?
সামনের
পূর্ণিমায় বিন্ধ্যবাসিনীর বিয়ে, সেই দিনটা পৰ্যন্ত থাকুক, তারপরে ছেড়ে যাবে আমাকে।
সামন্ত
সরকারী কর্মচারী হইলেও অমানুষ নন, হয়তো দক্ষিণাবাবুর অনুরোধ রক্ষা করিতেন, কিন্তু
জমিদার কন্যার বিবাহ সংবাদে মনে পড়িয়া গেল সামনের পুর্ণিমাতে তাঁহার পুত্রেরও
বিবাহ।
যে–কারণে
দক্ষিণাবাবুর হাতিটি প্রয়োজন‚ তাহার নিজের ক্ষেত্রেও সেই কারণ
উপস্থিত। বলা বাহুল্য এই দুই কারণের দ্বন্দ্বে সামন্ত বিজয়ী হইলেন, কারণ তিনি
আগাগোড়া ঘুষখোর সরকারের একমাত্র অনেস্ট অফিসার। আর দক্ষিণাবাবু হৃতসর্বস্ব সামান্য
জমিদার।
মাপ
করবেন দক্ষিণাবাবু ওটি পারব না। মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত কাছারী বাড়ী দখল নেওয়া
বন্ধ রাখতে পারি, কিন্তু
অস্থাবর সম্পত্তি ছেড়ে যেতে পারি না।
তবে
নিয়ে যান। কিন্তু একটু সাবধানে রাখবেন, বড় একগুঁয়ে জন্তু, ডানে যেতে
বললে বাঁয়ে যাবে, আমরাই
সময়ে সময়ে মুস্কিলে পড়ি,
ওখানে তো পড়বে নুতন লোকের হাতে।
আপনি
কিছু চিন্তা করবেন না। ভারত সরকার পঞ্চশীলের রশি দিয়ে রুশমার্কিনকে আষ্টেপৃষ্ঠে
বেঁধেছে, এতো
সামান্য একটা হাতি।
আমার
মাহুত বরঞ্চ গিয়ে সদরে পৌছে দিয়ে আসবে।
সেটা
মন্দ নয়। বলিলেন সামন্ত সাহেব।
সরকার
হাতি বাজেয়াপ্ত করিতেছে শুনিয়া দক্ষিণাবাবুর গৃহিণী সরকারের বাপান্ত করিলেন, বিন্ধ্যবাসিনী
কাঁদিল, কিন্তু
কর্তব্যবুদ্ধির হিমালয় সামন্ত সাহেবের সঙ্কল্প টলিল না।
মধ্যাহ্ন
ভোজন ও অপরাহ্ন নিদ্রা সম্পন্ন করিয়া সমস্ত গ্রামবাসীর নীরব অভিশাপের মধ্যে
হস্তীপৃষ্ঠারূঢ় বিজয়ী সামন্ত সাহেব ভাঙাকলসী গ্রাম ত্যাগ করিলেন।
জমিদার
পরিবার দুঃখে মুহমান ও নীরব, হঠাৎ কোথা হইতে দক্ষিণাবাবুর শিশুপুত্র ছুটিয়া আসিয়া
ব্যাপারটা কি যথাসাধ্য বুঝিতে চেষ্টা করিল, তারপরে দ্বিধামাত্র না করিয়া বলিল, দিদির
বিয়ের দিন মাতু আসবে।
সে
মাঝে মাঝে সম্ভব অসম্ভব অনেক প্রকার ভবিষ্যদ্বাণী করে, লোকে খুব
হাসে। কিন্তু আজ কেহ হাসিল না। আত্মীয়স্বজনের রসবোধের অভাবে বিরক্ত হইয়া সে
স্থানান্তরে প্রস্থান করিল।
দুই
সামন্ত
সাহেব বলিয়াছিলেন যে পঞ্চশীলের বাঁধন অতিশয় মজবুত, রুশ মার্কিন বাঁধা পড়িয়াছে। কিন্তু
হাতের কাছে সেরূপ দৃঢ় রজ্জ না থাকাতে মাতু ওরফে মাতঙ্গিনীকে লইয়া তিনি মুস্কিলে
পড়িলেন। সরকার হাতি পোষেন না; কাজেই সদরে বা মহকুমায় বা রাজধানীতে পিলখানা কিংবা মাহুতের
ব্যবস্থা নাই। তারপরে হাতির যে এমন অমিত ক্ষুধা তাহাই বা কে জানিত। এই দুর্মূল্যের
বাজারে মাতু দুবেলায় আধমণ চাল খায়— সঙ্গে ভাইটামিন হিসাবে পাঁচটি তাজা
কলাগাছ। সামন্ত সাহেব মাথায় হাত দিয়া পড়িলেন, গৃহিণীর কাছে বলিলেন— দেখছ খোরাকের
নমুনা।
গৃহিণী
কিছুমাত্র বিস্মিত না হইয়া বলিলেন, হাতির খোরাক বেশি তো হবেই। ও তো
তেমার পেট-রোগা হাকিম নয়।
সামন্ত
সাহেব বুঝিলেন, কথাটা
তাহাকে লক্ষ্য করিয়া। তিনি পেট–রোগা ও হাকিম দুইই সত্য।
সামন্ত
সুর বদলাইলেন, বলিলেন, ভাবছি
হাতিটা কলকাতায় পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিই।
গৃহিনী
রুষ্ঠকণ্ঠে ঝঙ্কার তুলিয়া তুলিয়া
শুধাইলেন, কেন, কেন?
সরকারের
জিনিস সরকারের কাছে চলে যাক। নিজের বাড়ীতে রাখা উচিত নয়।
সামন্তের
কথা শুনিয়া গৃহিণী স্বামীর মুখের কাছে হাত নাড়িয়া বলিলেন— কি আমার
ধর্মপুর যুধিষ্ঠির রে! নিজের বাড়িতে রাখা অন্যায়! ওসব ধর্মের কথা আর যেখানে হয়
শুনিও‚ এখানে নয়। হাতিটা
থাকবে, আমার
বাড়ীতেই থাকবে, আমার
সুরু ঐ হাতি চেপে বিয়ে করতে যাবে, বিয়ে করে বউ নিয়ে হাতি চেপে ফিরবে।
পাঁচ গাঁয়ের লোক দেখে বলবে— হ্যাঁ‚ একটা বিয়ে দেখলাম বটে।
সামন্ত
নিজের ফঁদে নিজে পড়িয়াছেন। হাতিটা লইয়া পৌছিয়া পুত্রের আসন্ন বিবাহে হস্তীপ্রয়োগের
মৎবটা তিনিই গৃহিণীকে জানাইয়াছিলেন। এখন আর ‘না’ বলেন কি উপায়ে ? কাজেই
হাতিটা সামন্তগৃহে থাকিয়া দৈনিক আধমণ চাল ও পাঁচটি তাজা কলাগাছ নিয়মিত আহার
করিতে থাকিল। সামন্ত মনে মনে সঙ্কল্প করিলেন বিবাহটা চুকিয়া গেলে হাতে পায়ে
ধরিয়া দক্ষিণাবাবুকে ফিরাইয়া দিয়া আসিবেন।
ইতিমধ্যে
সামন্ত গৃহিনী একদিন হাতি চাপিয়া হাওয়া খাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু
কার্যকালে দেখা গেল যে‚ হাতির ইচ্ছা অন্যরূপ। মাহুতের (সামন্ত একটা
মাহুত জোগাড় করিয়াছেন) উপরোধ‚ অনুরোধ‚ তারন পীড়ন
সত্ত্বেও মাতঙ্গিনী এক পা নড়ে নাই। তখন গৃহিনী ক্ষমার সুরে বলিয়াছিলেন‚
থাক‚ থাক‚ মাতু আমার বিয়ের বর ছাড়া আর কাউকে
পিঠে তুলবে না।
তারপরে
ব্যাখ্যার ছলে দর্শকদের বুঝাইয়া বলিলেন, এ তো যে–সে হাতি নয়‚
পাটহাতি। রকমসকমই আলাদা।
অতএব
পাটহাতি আম্রবৃক্ষতলে অচল অটল দাঁড়াইয়া রহিল। আর উদ্বিগ্ন সামন্ত বিবাহের দিন
গণনা করিতে লাগিলেন।
তারপরে
একদিন শুভদিনে শুভক্ষণে শ্রীমান্ সুরেন্দ্র রেশমী ধুতি চাদর চন্দন ও টোপরে
সুসজ্জিত হইয়া শঙ্খ ও সানাইয়ের ধ্বনির মধ্যে হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করিল, সঙ্গে দু'চার জন
বন্ধুবান্ধব চলিল। বরকর্তা ও অন্যান্য প্রবীণ বিজ্ঞজনেরা চলিলেন ঘােড়ার গাড়ীতে। নিকটেই একটি গ্রামে
কন্যা পক্ষের বাস। মাহুতের সঙ্কেতমাত্রে সেদিন হাতিটি যাত্রা করিল, কোনপ্রকার অসম্মতি
বা অশিষ্টতা জ্ঞাপন করিল না।
পুলকিত
গৃহিণী সকলকে শোনাইয়া শোনাইয়া
বলিলেন—কেমন বলেছিলাম, এ আমার পাটহাতি, বিয়ের বর না নিয়ে
নড়বে না। কেমন, এখন দেখলে তো!
সকলকেই
স্বীকার করিতে হইল যে দেখিল। কিন্তু তখন কেহই জানিত না‚ যে
এখনো
দেখিবার অনেক বাকি।
তিন
দক্ষিণাবাবু
নীরবে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া আছেন, গৃহিণী তারস্বরে কঁদিতেছেন, বিন্ধ্যবাসিনী
পাথরের মতো
নিশ্চল, অন্যান্য সকলে সময়োচিতভাব অবলম্বন করিয়াছে। নিকটবর্তী এক গ্রামে মেয়ের বিবাহ স্থির
হইয়াছিল। অদ্য বিবাহের দিন বিকাল বেলায় বরপক্ষ জানাইয়া দিয়াছে এ বিবাহে তাহাদের সম্মতি
নাই, কারণ স্বরূপ বলিয়া পাঠাইয়াছে বর আনিবার জন্য দক্ষিণাবাবুর হাতি পাঠাইবার
কথা ছিল, তিনি হাতি পাঠান নাই। কিন্তু আসল কারণ অন্যরূপ। জমিদারী বাজেয়াপ্ত
হওয়াতে দক্ষিণাবাবুর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তিনকাল একসঙ্গে ডুবিয়াছে। এই স্থুল
সত্যটিই বরপক্ষের আকস্মিক মতি পরিবর্তনের হেতু। যিনি ‘আখেরে’ জামাইকে দেখিতে পারিবেন না তাহার
কন্যাকে ঘরে লইয়া লাভ কি? তা ছাড়া বর নিজেও তৈরি ছেলে, ইতিমধ্যে
সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরূপে দু'চার বার বিদেশে যাইবার ফলে বিবাহ প্রথা সম্বন্ধেও সে
ভিন্নমত পোষণ করিতে সুরু করিয়াছে। ফলে সপরিবারে দক্ষিণাবাবু মাথায় হাত দিয়া
বসিয়া পড়িয়াছেন।
বিন্ধ্যবাসিনীর
মামা বলিল— হতভাগাটাকে
একবার হাতে পেলে মেরে হাড় গুড়িয়ে দিতাম।
দক্ষিণাবাবুর
জ্ঞাতি ভাই বলিল‚ আরে হাতে পেলে আর মারতে যাব কেন, কানে ধরে
পিঁড়িতে বসিয়ে দিতাম না!
মামা
কোট ছাড়িবার পাত্র নয়,
অবশ্যই পিড়িতে বসাতাম কিন্তু তার আগে একবার ধোলাই দিয়ে নিয়ে।
দক্ষিণাবাবু
বলিলেন, নাও
এখন চুপ করো। বাচালতা ভালো লাগছে না। তারপর বলিলেন— এই কদিনের মধ্যে সাতপুরুষের জমিদারী
গেল, কত
সাধের মাতু মা গেল— সে
সমস্তই সয়েছিলাম। এ যে অসহ্য। বলিয়া তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন।
হিন্দুগৃহে
যথা-নির্দিষ্ট
লগ্নে বিবাহ না হইলে সামাজিক ও মানসিক কিরূপ দুরবস্থা যে ঘটিয়া থাকে তাহার বিশদ বর্ণনা অনাবশ্যক। দক্ষিণাবাবু স্থির
করিলেন আজ রাত্রেই সপরিবারে গ্রাম ত্যাগ করিবেন। তিনি ভাবিলেন ক’দিন পরে তো
যেতেই হতো; কিন্তু
না, এর
পরে আর একটা দিন থাকাও অসম্ভব।
অবশ্য
অন্য বর সংগ্রহের একটা প্রস্তাব উঠিয়াছিল কিন্তু তাহার সুদূর মাত্র সম্ভাবনাও না
থাকাতে অনেকক্ষণ সে প্রস্তাব পরিত্যক্ত হইয়াছে। দীপহীন বাদ্যহীন আনন্দহীন রাত্রির
দণ্ডপলগুলি ক্লেদাক্ত সরীসৃপের মতো সেই বিমুঢ় পরিবারটির মাথার উপর দিয়া মন্থর
গতিতে চলিতে লাগিল।
চার
মাতঙ্গিনী
দ্রুত চলিতেছে। যে হাতি এতদিন এক পা নড়ে নাই; আজ যেন সে এতদিনের ক্ষতিপূরণ করিয়া
লইবার জন্য উদ্যত। বর ও তাহার বন্ধুগণ হাতির চালে অনভ্যস্ত, কৌতুক ও
কৌতূহলের সঙ্গে তাহারা সেই ঢেউয়ের দোলা উপভোগ করিতে লাগিল। আধ ঘণ্টাখানেক পরে
তাহারা দেখিল যে হাতিতে ও মাহুতে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হইয়াছে। মাহুত ঘন ঘন
অঙ্কুশের খোঁচা মারিতেছে আর হস্তীর অভিধানে যে সব বোধগম্য শব্দ আছে তাহা ব্যবহার
করিতেছে।
বর
শুধাইল--ব্যাপার
কি ?
মাহুত
বলিল—জানোয়ারটা
বড় পাজি।
কেন, বেশ তো
চলছে। বাবু, চলছে
বটে কিন্তু এ যে সুন্দরপুরের পথ ছেড়ে ভাঙাকলসীর পথ ধরলো।
সুন্দরপুর
কন্যাপক্ষের গ্রাম।
বর
এবার উদবিগ্ন হইয়া বলিল‚ ভাঙাকলসী আবার চল কেন?
ঐ
গ্রামে এতকাল ছিল কি না,
হাতিটা ছিল ভাঙাকলসীর বাবুদের।
এখন
উপায়?
ফেরাতে
চেষ্টা করছি, কিন্তু
গাঁয়ের পথের গন্ধ পেয়ে বড় দামাল হয়ে উঠেছে।
মাতঙ্গিনী
প্রমত্ত গতিতে ভাঙাকলসীর দিকে ছুটিল। বরপক্ষের কেহ বলিল, লাফিয়ে
পড়া যাক। কেহ বলিল,
ডাল ধ'রে
ঝুলে পড়ো। কেহ বলিল,
যেমন আছ বসে থাকো,
ওসব কাজের কথা নয়।
কাৰ্যতঃ
তাহাই হইল।
মাতঙ্গিনী
কিছুক্ষণের মধ্যে একেবারে ভাঙাকলসীর বাবুদের দেউড়িতে আসিয়া থামিল।
কে এলো, কে এলো রবে দক্ষিণাবাবুর বাড়ীর সকলে ছুটিয়া আসিল। সকলে বিস্মিত আনন্দে দেখিল
মাতঙ্গিনী।
‘পিঠে ও কারা ? ‘কোন্ গাঁয়ের বর গো? প্রভৃতি প্রশ্ন-বাণ ছুটিল।
‘পিঠে ও কারা ? ‘কোন্ গাঁয়ের বর গো? প্রভৃতি প্রশ্ন-বাণ ছুটিল।
অবশেষে সমস্ত অবস্থা শুনিয়া
বিন্ধ্যবাসিনীর মামা বলিয়া উঠিল, হাতে পেয়েছি, এবারে ঘা কতক আচ্ছা করে বসিয়ে দিই‚ সামন্তর
জন্য আজ আমাদের এই হেনস্তা।
বিন্ধ্যবাসিনীর কাকা বলিল,
আহা-হা ঘা–কতক দিতে হয় সামন্তকে
দিয়ো, আমি হাতে বর পেয়েছি, ছাড়ছি না।
তবে তুমি কি করতে চাও?
একেবারে পিঁড়িতে নিয়ে
বসাতে চাই।
বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে
যে এতখানি সম্ভাবনা নিহিত থাকিতে পারে কাহারো মনে আসে নাই। সকলে ‘জয়
মা আনন্দময়ী’ ধ্বনি করিয়া উঠিলেন।
আনন্দময়ী দক্ষিণাবাবুদের
কুলদেবী।
বিন্ধ্যবাসিনীর কাকা বলিল,
ঐ সঙ্গে একবার বলো‚ ‘জয় মা মাতঙ্গিনী’‚ ও না থাকলে
বর পেতে কোথায় ?
তারপরে ভাঙাকলসীর সকলে
এক প্রকার জোর করিয়াই বর ও বন্ধুদিগকে বাড়ীর মধ্যে লইয়া গেল।
বর আপত্তি করিলে এক বন্ধু
বলিল‚ তুমি তো আর ‘লভে পড়ে বিয়ে করছ না, এক জায়গায় না হয়ে অন্যত্র হলে ক্ষতি কি!
তাছাড়া, অন্য এক বন্ধু বলিল, এঁদের
যা ভাবগতিক দেখছি এখন চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
কাজেই বরপক্ষ বুদ্ধিমানের কাজ করিল। সত্য কথা বলিতে কি গতানুগতিক বিবাহের মধ্যে একটু এডভেঞ্চারের রস পাইয়া তাহারা কিঞ্চিৎ গর্বও অনুভব করিতেছিল।
অতঃপর পূর্ব-নির্দিষ্ট শুভক্ষণে সামন্তপুত্র শ্রীমান্ সুরেন্দ্রের সঙ্গে শ্রীমতী বিন্ধ্যবাসিনীর
শুভ-বিবাহ যথারীতি সম্পন্ন হইয়া গেল।
বিবাহান্তে বিন্ধ্যবাসিনীর মাতা গলবস্ত্রে মাতঙ্গিনীর পায়ে গড় হইয়া প্রণাম করিয়া এক কাঁদি কদলী নিবেদন করিলেন।
পাঁচ
পরদিন অতি প্রত্যুষে উদ্ভ্রান্ত সামন্ত
সাহেব সদলবলে দক্ষিণাবাবুর বাড়ী আসিয়া পৌছিলেন।
সারারাত্রি বরের ব্যর্থ সন্ধান করিয়া,
কন্যাপক্ষের কাছে লাঞ্ছিত হইয়া অবশেষে কি ভাবে মাতঙ্গিনীর পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া এ
গ্রামে আসিলেন সে বিস্তর কথা। দক্ষিণাবাবু তাঁহাকে যথোচিত অভ্যর্থনা করিলেন। সামন্তসাহেব
প্রথমে রাগ, পরে মুখ ভার, অবশেষে পুত্রবধূ দেখিয়া উৎফুল্ল হইলেন, বলিলেন প্রজাপতির
নিবন্ধ কে খণ্ডাতে পারে!
মেয়ে-জামাই বিদায়ের সময়ে দক্ষিণাবাবু সামন্তসাহেবকে বলিলেন, বেয়াই বিন্ধ্যবাসিনীর হাতিটা বিন্ধ্যবাসিনীর
সঙ্গেই যাক।
উদ্বিগ্ন সামন্তসাহেব বলিলেন— ঐটি মাপ করবেন, জমিদারের হাতি পুষবার
ক্ষমতা আমার নেই। তারপরে একটু ভাবিয়া বলিলেন, অবশ্য হাতি পুষতে পারে এমন অফিসারও আছে,
বুঝলেন কি না—সব ঘুষখোরের দরবার।
যাত্রাকালে দেখা গেল মাতঙ্গিনী সর্বাগ্রে গা ঝাড়া দিয়া প্রস্তুত হইয়াছে। দক্ষিণাবাবু বলিলেন—দেখলেন তো!
সামন্ত হতাশভাবে নিঃশ্বাস ফেলিয়া
বলিলেন‚ তবে
সঙ্গেই চলুক, কি আর করবো।
যাত্রার ঠিক প্রাক্কালে কোথা হইতে
দক্ষিণাবাবুর শিশুপুত্র ছুটিয়া আসিয়া বলিল‚ দেখো, আমি আগেই বলেছিলাম যে মাতু আবার
ফিরে আসবে।
ছবি: প্রতুল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (সৌজন্য: পূজাবার্ষিকী ‘জয়যাত্রা')
কি অার বলি ৷ মনটা ভরে গেল ৷
ReplyDelete