Saturday 3 January 2015

নিবন্ধ (মোবাইল ভার্শন): অজন্তার দেয়ালচিত্র (শিশির বিশ্বাস)

অজন্তার দেয়ালচিত্র
শিশির বিশ্বাস
(জেমস ফার্গুসনের আঁকা অজন্তা গুহার একটি অলিন্দ অজন্তা তখন হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল তস্কর প্রভৃতির উপদ্রব নিরাপত্তার জন্য রাখতে হয়েছিল উপযুক্ত প্রহরী ছবিতে তাদের কয়েকজন।)
অজন্তা গুহার দেযালচিত্রগুলির সমান্যই আজ বর্তমান গুহাগুলি অবশ্যই আছে আশপাশ আরও সাজানোগোছানো ভ্রমনার্থীদের জন্য আরও ভাল মানের হোটেল দেখভালের ব্যবস্থা কিন্তু যে ফ্রেস্কো তথা দেয়াল চিত্রগুলির জন্য অজন্তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি সেগুলি আজ আক্ষরিক অর্থেই দুর্দশাগ্রস্ত ধ্বংসের মুখে সর্বনাশটি ঘটেছে মাত্রই গত দুশো বছরে ১৮১৭ খ্রি গুহাগুলি একদল ইংরেজ সৈনিকের নজরে পড়ার পরে অথচ তার আগে গুহাগুলি যে সম্পূর্ণ লোকচক্ষুর অগোচরে ছিল এমন নয় অজন্তার মাত্র কয়েক মাইল দূরে ফর্দাপুর গ্রাম গ্রামের সবাই জানত গুহাগুলির দেয়ালে চোখ জুড়নো চিত্রগুলির কথা প্রচলিত ছিল চমৎকার এক গল্পও
অনেক কাল আগের কথা স্বর্গের দেবদেবীরা ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা জানালেন সবাই একদিন মর্তে বেড়াতে যাবেন স্বর্গের একঘেয়ে দিন আর ভাল লাগছে না একটা দিন মর্তে গিয়ে তাদের আনন্দফুর্তি করার ইচ্ছা ইন্দ্র তাঁদের প্রর্থনা মঞ্জুর করে বললেনকিন্তু মনে রেখ রাত ভোর হবার আগেই ফিরে আসতে হবে সম্মত হয়ে স্বর্গের গন্ধর্ব কিন্নর অপ্সরা দল বেঁধে হাওয়ায় ভেসে চলতে চলতে নেমে এলেন মর্তের এই অজন্তা গুহায় স্থানটি তাঁদের খুব পছন্দ হল বাগোড়া নদীর কাকচক্ষু জলে স্নান করে আনন্দে মেতে উঠল সবাই ইতিমধ্যে কখন যে রাত কেটে অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করেছে গুহার ভিতর কেউ বিন্দুমাত্র টের পায়নি শেষে একসময় ডেকে উঠল ভোরের পাখি ভয়ানক চমকে উঠল সবাই কিন্তু ততক্ষণে স্বর্গের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে অগত্যা যে যেখানে ছিলেন সেইভাবেই বন্দি হয়ে গেলেন গুহার দেয়ালে কেউ ছবি কেউ পাথরের মূর্তি   
হয়তো প্রচলিত এই গল্পের কারণেই গুহার দেয়াল চিত্রগুলির সামান্যতম ক্ষতি স্থানীয় মানুষ কখনও করেনি সেটা শুরু হল তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের আনাগোনা শুরু হতে যতদিন গুহাগুলি অরক্ষিত ছিল ততদিন তো হয়েছেই তারপর যথপোযুক্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা হবার পরেও সেই অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়েছে এমন নয় বরং সুরক্ষার নামে বেশ কিছু ছবির সর্বনাশ ঘটানো হয়েছে
অনেকেই বলবেন তাতে অজন্তার ভ্রমণার্থী তো কমেনি বরং বেড়েছে হক কথা তাই তো আজ গাইডরা দর্শনার্থীদের ফ্রেস্কো নয় দেখায় ছেলেভুলানো নানা জিনিসওই দেখুন মানুষের মতো পক্ষী দম্পতি। ওই যে ওদিকে ছয়জন অপ্সরা। গুনে দেখুন মাত্র ছয়টি হাত। অথচ না গুনলে বোঝার উপায় নেই। এদিকে দেখুন ডানদিক থেকে দেখলে মনে হবে বোধিসত্ব হাসছেন কিন্তু বাঁ দিকে থেকে তাকালে তিনি ক্রন্দনরত
আম দর্শকবৃন্দ তাতেই খুশি অজন্তা তো বেড়ানো হল বর্তমান প্রতিবেদক দুই নম্বর গুহায় এক শিক্ষিত মহিলাকে বিধুর পণ্ডিত জাতকের নাগকন্যা ইরান্দাতীর দোলনায় দোল খাওয়ার চিত্রকে রাধাকৃষ্ণ বলে সনাক্ত করতে দেখেছেন কারণ সহজেই অনুমেয় ইরান্দাতীর কাছেই দাঁড়িয়ে পূণ্যক সুতরাং রাধাকৃষ্ণ ছাড়া আর কী অথচ সঙ্গে গাইড তিনি মহিলার ভুল ভাঙাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি
অজন্তার মূল আকর্ষণ ফ্রেস্কোগুলি আজ তাই দর্শকদের কাছে প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে বলা যায় অথচ অজন্তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি ওই ফ্রেস্কোগুলির জন্যই প্রাচীন ভারতের চিত্রকলার এত বড় ভাণ্ডার আর কোথাও যে নেই এই দেয়াল চিত্রগুলির টানেই দেশ বিদেশ থেকে ছুটে এসেছেন খাতনামা শিল্প কলারসিকবৃন্দ দিনের পর দিন পড়ে থেকে তাঁরা একের পর এক ছবির অনুলিপি করেছেন ফিরে গিয়ে বইও লিখেছেন অনেকে বাংলার দুই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মুকুল দে ও অসিত হালদার তাঁদের অন্যতম
তবে অজন্তা আবিষ্কারের পর সেই প্রথম দিকে যাঁরা গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে জেমস ফার্গুসন ক্যাপ্টেন রবার্ট গিল বোম্বাই আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ জর্জ গ্রিফিথ এবং জেমস বার্জেসের নাম অজন্তা চিত্রশিল্পের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে এঁরা সেই সময় যেসব ছবির অনুলিপি করেছেন আদের অনেকগুলিরই আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে অজন্তার দেয়ালচিত্র তথা প্রাচীন ভারতের চিত্রশিল্পের স্বাদ পেতে হলে এঁদের আঁকা অনুলিপিগুলি তাই অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র অবলম্বন

(জেমস বার্জেসের আঁকা দশ নম্বর গুহার প্রায় দুই হাজার বছরের পুরোনো একটি দেয়ালচিত্রের অনুলিপি এক অনার্য রাজা সপরিবারে বৌদ্ধ স্তূপে অর্ঘ নিবেদন করতে চলেছেন।)

উদাহরণ স্বরুপ জেমস বার্জেসের আঁকা উপরের চিত্রটির কথা বলা যায় এক অনার্য রাজা সপরিবারে বৌদ্ধ স্তূপে অর্ঘ নিবেদন করতে চলেছেন খিপূ ১ম শতকের অর্থাৎ প্রায় দুই হাজার বছরের পুরোনো এই চিত্রটি রয়েছে ১০নং চৈত্য গুহায় গুহার দেওয়ালে চিত্রটির অবস্থান জানা থাকা সত্বেও খুঁজে পেতে বর্তমান প্রতিবেদককে যথেষ্টই বেগ পেতে হয়েছিল তারপর যখন সন্ধান পাওয়া গেল হতাশা বাড়ল আরও চিত্রটি এতটাই আবছা‚ অস্পষ্ট হয়ে গেছ যে হালকা কিছু রঙের ছোপ ছাড়া আর কিছুই প্রায় নজরে পড়ে না অথচ উনবিংশ শতকের শেষ পর্বে বার্জেস সাহেব যখন চিত্রটির অনুলিপি করেন তখন সেটি যথেষ্ট ভাল অবস্থায় প্রায় দুহাজার বছর যে ছবি অক্লেশে টিকে ছিল মাত্র একশো বছরেই তা প্রায় নিশ্চিহ্ন হবার মুখে 
অনেকেই বলেন‚ প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থীর আনাগোনা‚ গাইডদের হাতে প্রতিনিয়ত চড়া আলোর ঝলকানি ছবিগুলির দুর্দশার কারণ। হয়তো তাই। তবে তার চাইতেও বড় কারণ আনাড়ি হাতে উপযুক্ত পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই ছবিগুলি সংরক্ষণের নামে নানা রকম রসায়নিক আর রংয়ের যথেচ্ছ প্রয়োগ। মা ও ছেলে‚ কৃষ্ণ রাজকুমারী প্রমুখ কয়েকটি বিখ্যাত ছবির ক্ষতি এই কারণেই ঘটেছে। 
অজন্তা চিত্রশিল্পের প্রকৃত স্বাদ পেতে বর্তমানে তাই পুরোনো অনুলিপিগুলিই অন্যতম ভরসা শেষ করার আগে উৎসাহী পাঠকের জন্য জেমস বার্জেসের আঁকা ওই ১০ নং গুহার দুটি খণ্ডচিত্রের অনুলিপি:

No comments:

Post a Comment